যে নেহরু আসাম পরিদর্শন শেষে বিবৃতি দেয় “আমি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হলে অনেক আগেই হাঙ্গামার পরিণতিকে প্রতিহত করতাম,” সেই পণ্ডিত নেহরুকে আমি প্রশ্ন করি নিজে তুমি প্রধানমন্ত্রী হয়েও কি ম্যাজিষ্ট্রেটরা যা করতে পারেনি তা করতে পেরছ? পারনি—পার্টি স্বার্থের স্বার্থান্ধতায় ন্যায় বিচারে প্রবৃত্ত না হওয়ার দোষে কি তুমি নিজেও দুষ্ট হওনি পণ্ডিত নেহুরু?
যে রঞ্জিৎ বড়পূজারীর মৃত্যুতে তােমরা—অনেক নেতাই শোকের বন্যা বইয়ে দিয়েছ, তারা পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে Law & Order maintain করার ব্যাপারে যে দৃঢ়তা দেখায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রী, তার তত মােটেই প্রশংসা করনি। এ কোন্ নীতিতে তুমি চলেছ নেহরু তুমি কি শুধু অসমীয়া ভাষীদেরই প্রধানমন্ত্রী, বাঙ্গালীদের নয়। তবে বাংলা ও বাঙ্গালীদের সম্পর্কে তােমার এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ কেন? সংবাদপত্রের ওপর তুমি অতিরঞ্জনের দোষ চাপিয়েছ, কিন্তু ভিন্ন প্রদেশের যে সব সংবাদপত্র এত বড় একটা ঘটমান সংবাদ সম্পূর্ণ চেপে গেছে, যে শাসন হাঙ্গামায় প্রকৃত হতাহতের সঠিক সংখ্যা আজও পর্যন্ত দিতে পারে নি—তার ত কোন নিন্দাবাদ তুমি করনি? সংবাদপত্রকে সঠিক সংবাদ দেবার দায়িত্ব কি সরকারেরও পালনীয় নয়। তাই বলি পণ্ডিত নেহরু তুমি ভুল করছ ভুলই করছ—
*** **** ***
শুভ্রেন্দুর অসুখে উৎকণ্ঠিত শিবানী কোনক্রমে রাতের আহার শেষ করে। তারপর নিজের ঘরে এসে শয্যা নেয়। অবেলায় ঘুমিয়েছে বলে সহজে ঘুম এলাে না তার চোখের পাতায়। কাল রাতে তার দেহের ওপর দিয়ে যে পশুতার প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তার রেশ এখনও কাটেনি। সারা গায়ে ওর অসহ্য ব্যথা চাগিয়ে উঠছে থেকে থেকে। শরীরের কোষে কোষে যেন ব্যথার পীড়ন। ব্যথাহত শিবানীর মনে ভেসে উঠল নেশাতুর কানাইয়ের মুখটা। মনে পড়ল কানাইকে বলা কথাগুলাে। মনে হতেই শিউরে উঠল ও। না-না, এ হতে পারে না। শুভ্রেন্দু যে তার নারীজীবনের একমাত্র ঈস্পিত ধন।
শুভ্রেন্দু যেবার অনার্স নিয়ে বি, এ পাশ করে চৈত্র-শেষে দেশে এলাে খুব ধুমধাম করে সেবার ওরা “রঙ্গালী বিহু” উৎসব পালন করে। এটাই শিবানীদের বড় উৎসব। ও তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বিধিমত নববস্ত্রে বরতনু ঢেকে সকল গুরুজনকেই প্রণাম করেছে ও মায়ের নির্দেশ মত। শুধু একজন মাত্র তখনও বাকী সে শুভ্রেন্দু।
সকাল থেকে বই মুখে বসে আছে ছেলেটা তার ঘরে। এই বেশে ওঘরে যেতে, ওর সামনে যেতে, তার কৈশোের অতিক্রমা কুমারী মনে সে কী লজ্জা! অনেকক্ষণ চৌকাঠের ওদিকে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল যেন ও— to go or not to go, ঠিক এমনই সময় কি একটা কাজে রুণীবালা এ বাড়ীতে আসেন। তাঁর চোখে পড়ে এ যায় দ্বিধাজড়িত, লজ্জাবিধুরা মঞ্জুলমুখী শিবানী। তাই তিনি চেঁচিয়েই বলেন কাছে অমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে
—ও কিরে, শুভ্রর ঘরের আছিস কেন?
সঙ্গে সঙ্গে মমতাময়ীর উদ্দেশ্যে রুণীবালা হেঁকে বলেন:
—ও দিদি, দেখ এসে মেয়ের কাণ্ড! যার সঙ্গে ন্যাংটোপুটো থেকে কিল-চড়-চুলােচুলি দিয়ে ভাব—তার কাছে যেতে, তাকে প্রণাম করতে লজ্জা কি মেয়ের?
মায়ের এমন কথায় শিবানী তাকে একটা ভেংচি কেটে দিয়ে বিধুনিত মনে হস্তে শুভ্রেন্দুর ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তারপর ধীর পায়ে, নতমুখে এগিয়ে গিয়েছিল শুভ্রেন্দুর সামনে।
শুভ্রেন্দু নতুন শাড়ির খসখস শব্দ শুনে ও ঘ্রাণ পেয়ে চোখ তুলে বই থেকে শিবানীর মঙ্গল মুখে চাওয়ামাত্র মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সহসা শুভ্রেন্দুর মুখ দিয়ে যে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল, তা হল:
সুন্দর!
কথাটা শােনামাত্র শিবানীর শরীরের শিরায় শিরায় যেন কি এক সুরমূৰ্চ্চনার শিহর বয়ে গিয়েছিল। আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে না থেকে শুভ্রেন্দুর পায়ের কাছে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে ও এক ছুটে পালিয়ে এসেছিল। ত্বরিৎ নিজেদের বাড়ীতে ফিরে বড় ঘরে ঢুকে পড়ে দোর ভেজিয়ে দিয়েছিল। কম্পিত বক্ষে এগিয়ে বড় আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে নিজের রূপ দেখে নিজেও অস্ফুটে বলেছিল।
পরক্ষণেই এক মধুর উন্মাদনায় ও বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিল। সারা গায়ে কি যেন এক শিরশিরানি। জীবনে এর আগের অন্য কোন রঙ্গালী বিহু পার্বণে ও এবারের মত এত খুশী হয়নি। বুকের মধ্যেটায় একান্ত এক ধুকপুকুনি। কত না ভাল লাগা সে কাঁপন।
ঐ বছরই পৌষ সংক্রান্তিতে “ভােগালী বিহুর” দিনও সকালে স্নান করে, আগুনে তিল চাল অর্পণ করার পর দ্বিতীয়বারও সেই কাপড়টা পরে। তারপর সেই আগের মত লাজুক মন ও মুখ নিয়ে ঢুকেছিল গিয়ে শুভ্রেন্দুর ঘরে। শিবানীকে দেখে ঠিক আগের মতই শুভ্রেন্দু মুগ্ধ চোখে চেয়ে নরম স্বরে বলেছিল।
সুন্দর!
আর ঐ সুন্দর কথাটা শুনেই ও যখন চঞ্চল পায়ে পালাতে যাবে ঠিক তখুনই শুভ্রেন্দু অস্ফুট স্বরে আর একটা কথা বলেছিল:
—এই, শােন?
—উ।
এক অক্ষরের উত্তর সহ শিবানী ওর ডাগর ভাষাময় চোখ তুলে চকিতে চেয়েছিল। শুভ্রেন্দুর চোখের কৌতুকের ইসারায় পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল তার প্রায় নাগালের কাছে। শুভ্রেন্দু হাত বাড়িয়ে ওর এক হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ ধরে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নিয়েছিল ওকে। তারপর ওর সাবানঘষা ফর্সা সুন্দর হাতটা হাতে নিয়ে তাতে একে দিয়েছিল একটা আলতাে চুম্বন। সঙ্গে সঙ্গে শিবানীর হৃদয়তন্ত্রীতে সে কি চাঞ্চল্য ! হঠাৎ যেন সারা রােমে রােমে অনুভব করেছিল ও প্রথম যৌবনের জাগরণ! মুহূর্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একছুটে ও তক্ষুনি বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। আর আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াতে শুনেছিল এক সুন্দর সঙ্গীতের রেশ। হঠাৎই যেন দিনের আলাে উজ্জলতর হয়েছিল। পৌষের সে দুপুরেও অকালে কি মিষ্টি করেই না ডেকে উঠেছিল উঠানের আমগাছে একটা কোকিল।
ছুটে এসেছিল ও নিজের ঘরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন নতুন করে চিনেছিল। ওর মনে হয়েছিল কিশােরী মেয়েটি যেন মিলিয়ে গেছে, লীন হয়ে গেছে সদ্যজাগা যুবতীর দেহে। মিষ্টি একটু হেসে নিজের ডান হাতটা আস্তে আস্তে মুখের কাছে তুলে ঠিক শুভ্রেন্দুর একে দেওয়া চুম্বনের জায়গাটায় ছুয়েছিল নিজের সরু রাঙ্গা ঠোঁট। প্রতি অঙ্গে অঙ্গে যেন কিসের এক কি এক আবেশ যেন ছড়িয়ে পড়েছিল ওর দেহের কোষে কোষে। উন্মাদনা।
এরপর ‘ভােগালী বিহু’ উৎসবের অঙ্গ প্রার্থনায় বসে ওর বাবা সরযুপ্রসাদ যখন বলেছিলেন:
—“হে দেব সােনা রায়, তুমি বর দিয়া যাতে ঘর-গিরী ধনে বংশে চন্দ্র সূর্যর দর জিলিকি উঠে। কারণ তুমি সত্য, তুমি সুন্দর, তােমার দয়াত বিশ্বব্ৰাহ্মণ্ড চলি আছে। তুমি ইচ্ছা কৰিলে সকলো করিব পারা।”
ও কিন্তু তখন মনে মনে প্রার্থনা করেছিল।
—হে দেব সোনা রায়, শুভ্রদা যেন চিরদিন আমাকে আজকের মতই ভালবাসে। আমাদের ভালবাসা যেন চন্দ্র সূর্যের মত বিকশিত হয়ে ওঠে। সুর হয়ে ওঠে। সত্য হয়ে ওঠে। সার্থক হয়ে ওঠে…
বিছানা ছেড়ে নেমে শিবানী ওর ট্রাঙ্কটা খুলল। ডালাটা তােল মাত্র উপরেই রাখা রিভালভারটা ওর দু’চোখে যেন তীব্র যন্ত্রণার এক ঝাপটা মারল। ও চোখ বুজে অস্ত্রটা জ্যান্ত সরীসৃপ ধরার মত ধরে তুলে ছুড়ে দিল বিছানায়। তারপর ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে অতি যত্নে বের করল শুভ্রেন্দুর ফটোটা।
ফটোটা নিয়ে বিছানায় ফিরে এলো শিবানী। চোখের সামনে সেটা ধরে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলাে তার দিকে। দেখে যেন আশা মেটে না ওর। পাশে পড়ে থাকা রিভালভারটা হাতে নিয়ে মনকে শক্ত করে ফটোটার দিকে সেটা তাক করে ধরামাত্র হাতটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠে অস্ত্রটা খসে পড়ল।
এই শুভ্রেন্দুকে হত্যা করতে চায় কানাই কাকতি। যে শুভ্রেন্দুকে সে পেয়েছে বুঝি জন্মজন্মান্তরের সাধনার ফলস্বরূপ। সেবারই দুর্গাপূজার সময় মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখে ও যখন দলছাড়া হয়ে ফিরছিল শুভ্রেন্দুদের বাড়ীর সুমুখ দিয়ে প্রকৃতিতে তখন সন্ধ্যার আবছায়া। হঠাৎ কোথা থেকে কানাই ছুটে এসে খ্যাপা পশুর মত জাপ্টে ধরেছিল তাকে আর সেও সমুচিত শিক্ষা দিয়েছিল কানাই-এর গালে পাঁচ আঙ্গুল বসানাে ঘৃণার চড় কষে। সঙ্গে সঙ্গে সারা দেহ ওর ঘিনঘিনিয়ে উঠেছিল।
প্রায় সারা রাত ভাবনা-চিন্তায় জেগে সকালের দিকটায় চোখের পাতা এক করল শিবানী।
রুণীবালার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে নবউষার আভা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়বার আগেই। আজও আবছায়া অন্ধকারে তিনি উঠোনে গােবরজলের ছিটে দিচ্ছিলেন—ভাঙ্গা হাঁড়িটা হাতে নিয়ে। এমন সময় শিবানীর বুকফাটা আর্তনাদ কানে এলাে তার। চমকে ওঠায় হাত থেকে পড়ে গেল গােবর-জলের পাত্র। ভেঙ্গে গেল সেটা। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন মেয়ের ঘরের বদ্ধ দরজার কাছে। করাঘাত হানলেন দোরে। শিবানীর বাবারও ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে তাঁকেও দেখা গেল এস্তে মেয়ের ঘরের সামনে ছুটে আসতে। বদ্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে উদ্বেগভরে ডাকলেন দুজনে দ্বৈত কণ্ঠে:
—খুকী? খুকী?
সাড়া মিলল শিবানীর। সঙ্গে সঙ্গে দরজাও খুলল সে। বাবা-মা দুজনেই মেয়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখলেন—মুখে চোখে তার বিহ্বল ভাব। কি এক আতঙ্কের ছাপ। কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম।
—কি হল রে?
—স্বপ্ন। খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম মা!
রুণীবালা বিছানা থেকে পাখাটা নিয়ে এসে ঐ হাতেই মেয়ের মাথায় বাতাস করতে লেগে গেলেন। শিবানী তখনও স্বপ্নাচ্ছন্ন। সেই সেদিনের মত বিশ্রী স্বপ্ন—ঘনকালাে আঁধারের মধ্যে মা কালীর হাতের নৃমুণ্ডের মত শুভ্রেন্দুর ধড়ছাড়া মুণ্ডটা ভেসে বেড়াচ্ছে—গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটছে রক্ত…
একটু পরে হাত বাড়িয়ে শিবানী মায়ের হাত থেকে পাখাটা নিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে:
—তুমি কাজে যাও। আর হাওয়া করতে হবে না।
রুণীবালা পাখা রেখে অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চলে যান।
সাত সকালে গৃহাঙ্গন পবিত্র করতে গিয়ে বাধা পড়ায় মনে মনে একটা কিছু অমঙ্গলের আশঙ্কা ক’রে চিন্তিত হন।
দুঃস্বপ্ন দিয়ে দিন শুরু হওয়ায় শিবানীর মনেও ভাবনার অন্ত নেই। সুটকেশ খুলে টুথ ব্রাশটায় পেষ্ট ভরিয়ে নিয়ে কুয়ােতলায় গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে নিল ও। তারপর ঘরে এসে শাড়িটা ঠিকঠাক করে পরে নিয়ে রুণীবালার সামনে এসে বলল :
জ্যেঠিমাদের বাড়ী যাচ্ছি মা।
—কিছু মুখে না দিয়েই যাবি?
শুভ্ৰদার যে জ্বর কাল থেকে।
উদ্বেগকণ্ঠে বলে উত্তরের অপেক্ষায় না দাঁড়িয়ে খিড়কী দিয়ে বেরিয়ে গেল শিবানী।
শুভ্রেন্দুদের বাড়ীতে এসে দেখল মমতাময়ী প্রতিদিনের মত কুয়ােতলায় প্রাতঃস্নান সেরে নিচ্ছেন— আর জ্যাঠামণি বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে তামাকু টেনে যাচ্ছেন পরম তৃপ্তিতে। ওকে দেখে মুখ থেকে নলটা বের করে বললেন :
—এই যে মা-জননী, শুভ্রর জ্বরটা দেখ ত’ গিয়ে
—দেখছি জ্যেঠামণি।
বলে শিবানী শুভ্রেন্দুর ঘরের দরজায় গিয়ে হাত ছোঁয়াতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে মশারীর ভেতর চোখ বুজে নির্জীবের মত পড়ে আছে সে। মুখে-চোখে রােগ-যন্ত্রণার চিহ্ন সুস্পষ্ট। দেখে উদ্বিগ্ন হ’ল শিবানী। উদ্বেগভরে শুভ্রেন্দুর কপালে হাতের পিঠ রেখে দেখল এখনও জ্বর আছে। ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলল শুভ্রেন্দু।
শিবানী বলল:
—কেমন আছ?
—মাথাটা বডড ভার ভার মনে হচ্ছে। যন্ত্রণাও আছে সেই সঙ্গে।
—বলেছিলাম না সাবধানের মার নেই।
বলতে বলতে ও আলমারি থেকে থার্মোমিটার বের করল। তারপর সেটা খাপ থেকে খুলে শুভ্রেন্দুর হাতে দিল। টেবিলের টাইমপিসটার দিকে চেয়ে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট সময় অন্তে সেটা চেয়ে নিয়ে চোখের কাছে তুলে দেখল শিবানী জ্বর যেমন ছিল তেমনি আছে।
—কি, জ্বর কমেছে?
প্রশ্ন করে শুভ্রেন্দু
—না। তবে?
—যা ছিল তাই আছে।
—ওঃ।
—এখন মুখ-হাত ঘােবে না দেরী হবে?
যেমন বলবে!
নির্লিপ্ত স্বরে বলে শুভ্রেন্দু।
শিবানী কুয়ােতলায় গিয়ে দড়ি-বালতি নামিয়ে জল তােলে। বালতি ভরা জল ও ঘটি নিয়ে এসে শুভ্রেন্দুর ঘরের সামনে বারান্দায় রাখে। তারপর ঘরে গিয়ে টেবিল থেকে ব্রাশ নিয়ে তাতে পেষ্ট ভরিয়ে দিতে দিতে বলে :
—উঠে পড় এবার।
শুভ্রেন্দু গায়ের চাদরটা একপাশে সরিয়ে উঠে পড়ে বিছানায়। মেঝেতে নেমে পায়ে শ্লিপার গলিয়ে নিতেই শিবানী তার হাতে ব্রাশটা গুজে দেয়। শুভেন্দু চলে যায় বারান্দায়—শিবানী এই অবসরে পরিত্যক্ত বিছানাটা পরিচ্ছন্ন করে দেয়। টেবিল ও সেলফটার জিনিসগুলাে গুছিয়ে নেয়। তারপর ও চলে যায় রান্নাশালে মমতাময়ী তখন উনানে চায়ের জল চাপিয়ে আনাজের ঝুড়ি নিয়ে বঁটি পেতে বসেছিল। ঘরে ঢুকে ও মমতাময়ীকে বলে:
—আমি কুটছি তরকারী, কতদিন যে বঁটিতে বসিনে জ্যেঠিমা। ভুলেই গেছি বুঝি।
—তুই কুটবি? আচ্ছা আয়।
বলে বঁটি কাত করে রেখে উঠে পড়েন মমতাময়ী। এগিয়ে যান বাষ্প ওঠা কেতলির দিকে। সাঁড়াশী দিয়ে ধরে সেটা নামিয়ে নেয়। চায়ের কৌটো থেকে টি পটে চা দিয়ে তাতে জল ঢেলে ঢাকনা আটকিয়ে দেয়।
—শুভ্রদা কি খাবে জ্যেঠিমা?
—দুধ দোয়ানাে হলে এখন ত এক কাপ দুধ দে ওকে। কথা বলতে বলতে মমতাময়ী চা ঢালে কাপে। শিবানী একমনে কুটনাে কুটে যায়। মনের মধ্যে তখন ওর কেতলির জলের মতই চিন্তা যেন টগবগিয়ে উঠছে। ভাবে ও কাল কানাইদার বাড়ীতে গিয়ে অতটা দুঃসাহস না দেখালেই হত। কিন্তু না যদি যেত ও ওদের ঐ ঘন ঘন শান্তি কমিটির মিটিংয়ের অছিলায় শুভ্রেন্দুকে ডেকে নেবার রহস্যটাকে ত’ জানতাে না। কিন্তু জেনেই বা কি করতে পারে সে। আর কিছু না হক অন্ততঃ একদিনের জন্য ওদের প্রধান হাতিয়ার রিভালভারটা নিয়ে ত এসেছে। কিন্তু এনেই বা লাভ হ’ল কি। সেই সঙ্গে নিজের ওপর কতটা ঝুঁকি নিয়েছে। সন্ধ্যার আবছায়ায় ও যখন যাবে রিভালভার ছোড়া শিখতে তখন কানাই কাকতি একলাটি পেয়ে যদি কিছু করে বসে তাছাড়া ক’দিনই বা সে কানাইকে নিরস্ত করতে পারবে। কদিন সে পারবে শুভ্রেন্দুর জীবন-প্রদীপের শেষ হয়ে আসা সলতেটা চাতুরির কাঠি দিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে যেতে।
এ সব ভেবে বড় অসহায় মনে হয় ওর নিজেকে। বুকের ভেতরটায় গুমরে ওঠে একটা ব্যথা, অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা একটা অপ্রতিরােধ্য অসহায়তা, উপায়হীনতার একটা আক্ষেপ। নিজের অজান্তেই এক সময় ওর চোখের কূল ছাপিয়ে জল এসে যায়। চা তৈরী শেষ করে মমতাময়ী ওর দিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায়। তাই ত! কাঁদে কেন মেয়েটা, কি হ’ল এমন, এরই মধ্যে? শ্রাবণের মেঘের মত মুখটা থমথমে দেখেছিল বটে, কিন্তু সে মেঘ যে চোখের জলের বৃষ্টি হয়ে ঝরবে এতটা আশা করেনি মমতাময়ী। মনে মনে ভেবেছিল শুভ্র বলতে ও যা অজ্ঞান তার অসুখের জন্যই বুঝি উৎকণ্ঠিত।
–কি রে, কি হল মা তাের?
অপ্রস্তুতের একশেষ শিবানী! তাই ত’, সত্যিসত্যি চোখে যে ওর জল! যে জল কিনা ও মুছতেও পারে না হাত বাড়িয়ে বা রুখতেও পারে না সংযমের শাসনে। করে কি এখন শিবানী। কারণ হিসাবে সে কি বলবে মমতাময়ীকে? ধরা পড়ে গেছে যে!
—কি রে মা চোখে জল কেন? কি হয়েছে।
মাথা নাড়ে শিবানী, কথা সরে না মুখে। একটা বােবা অনুভূতি যেন কণ্ঠ অবধি ওর সব উঠে কথা আটকে ধরে।
—লক্ষ্মী মা আমার, যে জন্য তাের চোখে জল, এই হঠাৎ কান্না, আমায় বল?
কি জবাব দেবে শিবানী? মনের সব হাহাকার কি বাইরে প্রকাশ করা যায়? তার ছােট্ট মনের পরিধিতে এ কদিন ধরেই ত’ সমানে চলেছে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের ঝড়। তা’ কি বলা যায় কাউকে, সে সব যে তারই একান্ত কথা। শিবানী মনে মনে ভাবে সে বলবে— এমনিই। কিন্তু বলতে গিয়ে ভাবাবেগে কিছুই বলতে পারে না। ঠোঁট দুটো শুধু কাঁপে বারকয়। চোখ টলটল করে ক’ফোটা জল রূপােলী রেখা হয়ে গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
মমতাময়ী ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে ওর কাছটিতে এসে সেটা নামিয়ে সান্ত্বনার স্বরে বলেন:
—আমায় বল মা, কি হয়েছে?
শিবানী যেন প্রাণপণে তার অন্তরের উদ্বেল উচ্ছাসকে সংযত করবার চেষ্টা করে। তারপর ভেজা কন্ঠে বলে সেই দুঃস্বপ্নটার কথা-শুভ্রেন্দুর ধড়হীন মাথাটা মা কালীর হাতের নৃমুণ্ডের মত কালাে আঁধারে ভাসছে। শুনে আঁতকে ওঠেন মমতাময়ী। ভীষিত কণ্ঠে বলেন :
—না-না-না, এ হতে পারে না, হতে দিতে পারি না আমরা। ওযে আমার একটি মাত্র অমাবস্যার সলতে রে মা।
কথা শেষ করে ঝরঝর করে মমতাময়ী কেঁদে ফেলেন। কথা ত নয় জননী হৃদয়ের হাহাকার যেন।
এবার শিবানীর পালা তাকে সান্তনা দেবার। কিন্তু তার আগেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মমতাময়ী উঠে পড়েন। কম্পিত কণ্ঠে বলেন:
—ওগাে শুনছো, শিবী কি বিশ্রী স্বপ্ন…
ব্যাপারটা নিয়ে একটা হৈ চৈ হােয়ে, কথাটা পাঁচ কান হােক এ কিছুতেই চায় না শিবানী। একটা দুর্বল মুহূর্তে মমতাময়ীকে মনের কথাটা বলে ফেলে সে ভুল করেছে। এর যে এমন একটা reaction হবে তা ও ভাবতে পারেনি। অনুশােচনায় ভরে যায় ওর মন। এ প্রসঙ্গ নিয়ে বাড়াবাড়ি একটা কিছু হ’বার আগে সে সেটা প্রতিহত করতে চায়। তাই সে মুহূর্তে দৃপ্তা হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে উজ্জলিত। ত্বরিৎ দাঁড়িয়ে উঠে ও দু পা এগিয়ে মমতাময়ীর হাত ধরে ঝাকানি দিয়ে কঠিন স্বরেই বলে :
সে অস্বাভাবিক স্বর শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মমতাময়ীর কান্না। ঘুরে দাঁড়ান তিনি।
—তুই বুঝিস না মা, ও যে আমার সারা জীবনের সাধনা।
—বুঝি জ্যেঠিমা, কিন্তু বুঝিনে সামান্য স্বপ্নটা নিয়ে অমন হৈ চৈ করার কারণ। তা ছাড়া তুমিই বলেছ একদিন-খারাপ স্বপ্ন পাঁচ কান হওয়া ভাল নয়।
—কিন্তু ও যে আমাদের…
–ও কি শুধু তােমাদেরই জ্যেঠিমা, আমার কেউ নয়, কিছু নয়?
—বুঝেছি রে মা, কিন্তু তবু যে আমার মাথাটা ঘুরছে, মনটা উথাল পাতাল করছে। শিবী, মা, আমায় ধর ধর—
দু’হাত বাড়িয়ে মমতাময়ীকে বুকে টেনে নেয় শিবানী। শিশুর। মত উচ্ছসিত কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে থাকেন তিনি। শিবানীর চোখ দিয়েও গড়াতে থাকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুজল।
নো ট : বা না ন অ বি কৃ ত