“ঠিকানাটা চেয়ে দেখি,নিচুপানে ওধারে, লেখা আছে কলিকাতা,সে আবার কোথা রে,ওপারের জেলে খুঁড়ো মাথা নেড়ে কয় সে, হেন নাম শুনি নাই আমার এ-বয়সে।”
সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে লিখলাম।একসময় পুরো মুখস্ত ছিল।ভুলও হতে পারে।কলকাতা নিয়ে এই ছড়া লিখেছিলেন সুকুমার রায়।সত্যিই তো,কলকাতা নামে কোন রেলস্টেশন নেই।শিয়ালদহ এবং হাওড়া এই দুটি রেলস্টেশন।কলকাতা নামে কোন বন্দর,হাওয়াই আড্ডাও নেই।
অসম তখন জ্বলছে।প্রবল আন্দোলনে উত্তাল রাজ্য। নগাঁও জেলার নেলীতে গনহত্যায় মারা গেছেন দুই হাজারেরও ওপরের মানুষ।আমরা কলকাতার নিরাপত্তার ঘেরাটোপে।এমন সময়ই এল সেই বহু প্রতীক্ষিত বন্ধুর তারবার্তা,যা আজ মৃত,অন্তর্হিত।”পাসড্ এগ্জাম,কাম সুন।” খুশির দিন,নাচো রে রিমঝিম।জীতেন্দ্র কোন এক সিনেমায় ডফলি বাজিয়ে খুব বিষাদের সেই গান গেয়েছিল,যখন প্রেয়সীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আমার কাছে তো খুলে গেল চল্লিশ চোরের গুহার দ্বার।
তখনকার দিনে টু টায়ার বলে রেলের কামরা ছিল।দুটো বার্থ। তখন কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন কাউন্টার ছিল না।ছিল না আই আর সি টি সি।ফেয়ারলি প্লেস থেকে টিকিট কাটলাম।রিজার্ভেশন বলাবাহুল্য, নেই।কিন্তু যেতে তো আমাকে হবেই।সঠিক দিন ও সময়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর পর ভাবছি কী করি।একটা কোচ পছন্দ করে উঠে পড়লাম।টিটি একটু ঘেরাওমুক্ত হলে,বললাম,”স্যার।আমি অসমে থাকি,ব্যাঙ্কের দুটো পরীক্ষাই পাশ করেছি, ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে।” তখন স্টেট ব্যাঙ্কের জন্যে ছিল,রিজিওনাল রিক্রুটমেন্ট বোর্ড,সংক্ষেপে আর আর বি,আর অন্য সমস্ত ব্যাঙ্কের জন্যে বি এস আর বি,ব্যাঙ্কিং সারভিস রিক্রুটমেন্ট বোর্ড।আমি দুটোতেই যে কোন কর্মফলে লিখিত পরীক্ষা পাশ করলাম,সে আজও এক অতিকায় রহস্য হয়েই রইল। টিটি আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,”আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”ট্রেনের কামরার এককোনে বেজার মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি,যেতে আমাকে হবেই আর আমি যাবই,প্রয়োজনে বাথরুমের পাশে মেঝেতে বসেও। অনেক ক্ষণ বাদে তিনি এলেন,”টিকিট দেখি।” দেখালাম।”এই যে তোমার রিজার্ভেশন।” টিকিটের ওপর খসখস করে কী যেন লিখে দিলেন।আপনি থেকে তুমি! আমার খারাপ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।আসলে স্নেহ,আদর।স্নেহ নিম্নগামী, সঞ্জীবচন্দ্র লিখেছিলেন। বুকের ভেতর হুহু করে ঢুকছে গঙ্গার হাওয়া।চোখ খচখচ করছে, যেকোন সময় বেরিয়ে আসবে জল।”চাকরি পেলে আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে।মনে থাকবে তো।” আমরা কত কিছুর কাছে ঋণী থাকি।শোধ করা অসম্ভব,বাতুলতা।চেষ্টা করা ও নির্বোধের মতো কাজ।সেই টিটি স্যারের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি,মিষ্টিও খাওয়ানো হয়নি।তবে, যাবারবেলা আমাকে ঋণী করার সঙ্গে সঙ্গে একটা শিক্ষাও দিয়ে গেলেন।যতটুকু পারো অন্যের জন্যে কিছু করার অন্তত চেষ্টা করো।
এ কোন শহর আমার! চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি।আমার দিদির বাড়িই উঠলাম।রাতে দেখি সারা পাড়া দীপাবলীর রাত।প্রত্যেক বাড়িতে যত বেশি সম্ভব আলো জ্বলছে।সবার মনেই এক চাপা আতঙ্ক, পরস্পরের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস।রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়ি খেতে হলো।তারপর দেখলাম প্রত্যেকের হাতেই একটা অস্ত্র।আমার হাতে যে ছুরিকাটি দেওয়া হলো,তাতে যে কতটুকু কার্যসাধ্য হবে সেই বিষয়ে আমার বিস্তর সন্দেহ। পালা করে রাত জাগা ঠিক হলো।আমি শেষরাতের দিকের দায়িত্ব নিলাম।সকলকে সচকিত করার জন্যে টিনের ক্যানেস্তারা বাজানোরও আয়োজন রয়েছে।রাত যত বাড়ে সবাই কান পেতে রয়,কোথাও কি হল্লার শব্দ শোনা যায়,কোন মানুষের বিশাল দল কি এগিয়ে আসছে?এতই ভয়,শঙ্কার অনিদ্রার রাত।সকাল হলেই একটু স্বস্তি যদিও, খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কেউ খুব বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি করে না।
স্টেট ব্যাঙ্কের ইন্টারভিউয়ের জন্যে এমপ্লয়মেন্ট অফিসে নাম অন্তর্ভুক্তি করতে হবে।আমার নেই।কী করা?এমনিতেই আমি বাঙালি এবং পারমানেন্ট আ্যডরেস শিলচর।না-হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।আমার এক অসমীয়া বন্ধুকে বললাম, এই কাজটা করতেই হবে।সে তো কোন সমস্যাই দেখল না।বলল,”বোল, এতিয়াই,একেদিনে হই যাব।”ওর সঙ্গে গেলাম, ফর্ম ফিলআপ করলাম,এবং সত্যি সত্যি একদিনেই কাজ হয়ে গেল।এরকম এক সময় যখন চারিদিকে অবিশ্বাস,কাজকর্ম প্রায় স্তব্ধ, একদিনে কাজ বের করে আনা,আ্যমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম অন্তর্ভুক্তি করা একটা ম্যাজিকই বটে।
এবার ইন্টারভিউ। সত্যজিৎ রায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” মনে পড়ল।চাঁদের ওজন জিগ্যেস করবে না তো, কোন গম্ভীর কণ্ঠ, হোয়াট ইজ দ্যা ওয়েট অফ মুন?সম্পূর্ণ ব্ল্যাঙ্ক হয়েই গেলাম দুটো ইন্টারভিউ দিতে।”কী করছ,আজকাল।” “স্যার, বি এস সি পড়ছি।আর সঙ্গে টিউশন করি।” “ওকে,এল সি এম আর এইচ সি এফ কী?” মিরেজ কী বলো, উইথ সায়েন্টিফিক এক্সপ্লেনেশন।” “হবি কী?” “ও, গান শোনা? নিজের পছন্দের একটা গান গাও।” “ও অচানক আ গয়ি,ইউ নজরকে সামনে,যেইসে নিকল আয়ি ঘটা সে চাঁদ।” সারা জীবনের সংগ্রহীত দরদ ঢেলে গাইলাম।
চাকরিটা আমি পাচ্ছি না,বেলা শুনছ।জঘন্য ইন্টারভিউ দিলাম,দুটোই।”ইয়ে দুনিয়া, ইয়ে মেহফিল মেরে কাম কি নেহি।” তুমি চলে যাও সিঁদুরদান টান নিয়ে, যেখানে তোমার মানুষ,সারাজীবনের।”তেরি গলিয়োমে না রখেঙ্গে কদম,আজ কি বাদ।তুমসে মিলনেকো না আয়েঙ্গে সনম,আজ কি বাদ।”
কোন বছরের পুজো ছিল সে যেন? বন্ধুর বাড়ি খালি থাকবে, আমাদের আনন্দাশ্রম। মদ খাবো জীবনে প্রথম। পানবাজারের বি এন দে আর ফ্যান্সি বাজারের খুবচান্দ। এখনকার মতো দু’পা এগোলেই দোকান টাইপ নয়।এক বন্ধু স্পনসর করবে। সে ও প্রথম টানবে মাল,বলেছে আকণ্ঠ খাবে, প্রয়োজনে হসপিট্যালাইজড হতেও রাজি। দিন ঠিক হলো।অষ্টমীর রাত।কে কিনে এনেছিল জানি না।সন্ধ্যা পেরিয়ে অষ্টমীর রাত নামল শহরে।আমাদের মধ্যে এক বন্ধু কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। আর কত অপেক্ষা করা যায়!ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।খোল বোতল,ঢালো স্বপ্ন। তেতো কেন এত?আর যখন নামছে ভেতরে কীরকম একটা জ্বালা।একপাত্র শেষ।ভালো লাগছে, রিমঝিম।দুই পাত্রের পর, পৃথিবী এত সুন্দর!তিন পাত্রের পর,আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।এরপর আর কী হয়েছিল,আজ আর আমার মনে নেই।একটা কথাই মনে আছে, বন্ধুবর বিছানায় শুয়ে এক পা তুলছে আর নামাচ্ছে, মুখ দিয়ে একটাই শব্দ ক্রমাগত বেরিয়ে চলছে,”স্বর্গ!”
চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা শুনছ।স্টেট ব্যাঙ্কেই ঢুকে পড়লাম।পোস্টিং, গৌহাটি রিফাইনারির শাখা।উলুবাড়ি থেকে গৌহাটি ক্লাব,সেখান থেকে বাসে নুনমাটি।এদিকে আন্দোলন তীব্রতর।রাজপথে রক্ত দিয়ে লেখা হচ্ছে,”তেজ দিম,তেল নিদিউ।” রক্ত দেব,তেল দেব না।এদিকে তেলের ভাণ্ডারে আমার চাকরি।প্রায়ই নিস্প্রদীপ,পথ বন্ধ।কতদিন যে হেঁটে এসেছি,একদিন তো আ্যম্বুলেন্সের ভেতর।সবসময়ই বুকের ভেতর ভয়।ব্যাঙ্কে সবাই ভালোবাসে, খেয়াল রাখে,সে নিয়ে সমস্যা নেই।যাতায়াতই টেনশনের।
এবার তো আমার অরণ্যকে নিয়ে আসতে হয়।১৯৮৪ র পুজো।বন্যায় রেললাইন উপড়ে গেছে।আমি যাবই কলকাতা,যেখানে টিকিবাঁধা তারে,গাড়ি চলে।আগের দিন রাতে, গৌহাটি রেলস্টেশনে নিদ্রা, জাগরণ।পরের দিন ভোর ভোর স্টেশনের সামনে বাসে করে গোয়ালপাড়া।পঞ্চরত্ন থেকে লঞ্চে যোগীঘোপা।সেখান থেকে ট্রাকের মাথায় চেপে বঙ্গাইগাঁও।এরপর জনতা এক্সপ্রেসে চেপে ব্যান্ডেল হয়ে যখন সোদপুর নামলাম,আমি তখন ঝুলোকালি মাখা এক কাকতাড়ুয়া।বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তুমুল স্নান আর কবজি ডুবিয়ে লুচিমাংস খাওয়া।সপ্তমীর সন্ধ্যা নামল শহরতলীতে।এবার অরণ্যে যাব।বন্ধুর ইয়েজডি বাইক।অনেক খুঁজেও পেলাম না।ভাঙা মন নিয়ে এলাম ব্যারাকপুর।শিবের প্রসাদ।খেয়ে রক্তজবা চোখ।বাড়ি ফিরলাম মধ্যরাত পার করে।
অরণ্যকাহিনি আজ থাক। শেয়ালদহের প্রাচী সিনেমাহলের পাশের এক ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসে চার চক্ষুর মিলন,যদিদং হৃদয়ং তব।ছবি তোলা হয়েছিল,একটাও ওঠেনি।স্মৃতিগুলো রইল মনে।যেদিন চেতনা স্তব্ধ,স্মৃতিও বেমালুম লোপাট।কার কী কাজে লাগে! ফুলের বাসর ছিল সেই রাত।অজস্র ফুল, ফুলের গয়না।রাতে ঘুম ভাঙে।পাশে দেখি জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে নবপরীণতা একটি মেয়ে।বুক ছ্যাত করে উঠল।এতদিন তো বেশ ভালোই ছিলাম,এলোমেলো জীবনে।এখন দায়িত্ব এসে গেল আরেকটি প্রাণের।পারব তো?শুরু হলো অন্য এক জীবন,শৃঙ্খলাবদ্ধ,দায়িত্বের,যৌথযাপনের।লেখালিখিতে আরো মনোযোগ দিতে দিতে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে অভিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে যুগ্মভাবে,”মহাবাহু” কবিতা পত্রিকা।অন্য এক পৃথিবীর দিকে হাঁটা শুরু।
দশটি পর্বে শুধু আবোলতাবোল।যা বলার ছিল, বলা হলো না।যা বলেছি,শুধুই ধুলোযাপন।কিছু কথা,মুহূর্ত, আনন্দ,বেদনা রেখে দিলাম আমার শার্টের বুক পকেটে।আমার সঙ্গে থাকুক না।যারা ধৈর্যে আস্থা রেখেছেন,তাদের প্রণাম।এই জীবন ভরপুর ঋণের।এই জীবন প্রিয় মানুষের সঙ্গ,এই জীবন সংঘর্ষের।একটি জীবন,ভালোবাসায় চন্দনচর্চিত।আবার দেখা হবে কোথাও, কখনো,এক কাপ চায়ে,একটি সিগারেট টানে।আস্থা রাখি সম্পর্কে, আস্থা রাখি বিশ্বাসে,আস্থা রাখি ভালোবাসায়।
তারাশঙ্করের “কবি” বলেছিলেন, জীবন এত ছোট কেনে।একদিকে জীবন ছোটই।এই তো কিছুদিন আগেও,খুব বেশি দিন নয়,এক বোহেমিয়ান যুবক কবে প্রৌঢ় হয়ে গেল,যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে ওই,শক্তিপদকথিত,আরো একটু ভালোবাসা আছে বুকে, বিলিয়ে যেতে একটু দেরি হবে।কত দেরি,কবি?হ্যাঁ, অমিতাভ গুপ্তকে স্মরণ করি,ভষ্ম থেকে তুলে এনে কবি নামে ডাকো।কত দেরি,হে বাউণ্ডুলে?কতটা সময় চাই তোমার? সে তো জানিনে।ভালোবাসা যে বুকে অনেক।ছিঁড়ি,তাহলে তন্তুজাল।মায়া,মোহ,লোভ,ঈর্ষা,অভিমান,প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি? ছিঁড়ে ফ্যালে এক মহামরণযানে অন্তরিক্ষে বিলীন!যাই?
এস ঢেউ,তরঙ্গায়িত করো
পাপস্খলন হোক
নির্বান দাও
আমাকে সম্পূর্ণ নাও
মোক্ষভবন থেকে বের করো
পরিত্রাণ দাও
খুব ভালো লিখেছেন সঞ্জয়দা।