পণ্ডিত নেহরু, তুমি পঞ্চশীলকে এ যুগের জাতিগুলােয় পরস্পরের সহাবস্থানের মহামন্ত্র বলে চালু করবার কত না চেষ্টা করেছ ও করছ, কিন্তু তােমার দেশের লােক যেখানে তােমারই শাসনকালে পরস্পরের সংগে স্ব স্ব ধর্মমত ও সংস্কৃতি নিয়ে নিরুদ্বেগে বসবাস করতে পারছে না, সেখানে বিদেশের রাষ্ট্রগুলি এই পঞ্চশীলে আস্থা রাখবে, এটা কি করে আশা কর? কম খেসারৎ দিয়েছ তুমি পঞ্চশীল-এর পেছনে? চীন তােমার দুর্বল নীতির জন্যই মূলত ভারত ভূখণ্ড করেছে আক্রমণ, দালাইলামাকে তােমার দুর্বল নীতির বলি হয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে এসে পরবাসী হতে হয়েছে। তােমার আশ্বাসেই যে দালাইলামা সেবার দেশে ফিরে গিয়েছিল, সেই দালাইলামাকে তুমি তাঁর মর্যাদা মত স্বাধীন ভাবে ভারতে বাস করতে দিয়েছ কি? তােমার দুর্বল নীতি চীনকে তােষণের নামান্তর করেও তাঁকে ভারতসীমান্ত ছাড়া করতে পারেনি পারবে বলেও আমি মনে করি নে। রাজনীতি দুর্বলের নীতি নয়—এ ক্ষাত্র নীতি। এখানে জোড়া-তালিতে চললে—তালির পর তালি বেড়েই যায়। তাই প্রয়ােজন দৃঢ়তার, প্রয়ােজন দ্বিধাহীন নীতি নির্ধারণের। লােকে বলে শান্তির জন্য নােবেল লরিয়েট’ হ’বার আশায় তুমি এই ভাবে একটার পর একটা ভূখণ্ড বা কোটি কোটি অর্থ উপঢৌকন দিচ্ছ পাকিস্তানকে। ওরা কাশ্মীর প্রশ্নে বেয়নেট ও বন্দুক তাক করলেও তুমি তার পরিবর্তে প্রেমানন্দে বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছ। এক শ্রেণীর লােকের এই গুঞ্জন কি সত্য নেহরু?
সত্যিই কি তুমি তােমার একটি খেয়ালের জন্য সমগ্র জাতিকে দিয়ে দেওয়াচ্ছ খেসারতের পর খেসারৎ।
তােমার শাসনে সুলােকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে বাঁচা দায়। লােকে যতক্ষণ না ঘেটি পাকাচ্ছে—যতক্ষণ না ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে বড় রকমের কোন গণ-ডেপুটেশন-এর আয়ােজন করছে, ততক্ষণ তােমার শাসন কারও সুস্থ দাবীতে কর্ণপাত করে। তুমি কি মনে কর ভদ্র নিরুপদ্রব জীবন যাপনে আস্থাশীল মানুষরা কথায় কথায় মিছিল বের করবে? ‘মিছিলের শহর কলকাতা’ বলে যে তুমি উপহাসবাণী উচ্চারণ করেছিলে—সেই তােমার শাসনযন্ত্রই যে বলে মিছিল করে সংঘবদ্ধ না হলে সরকারের বধির কর্ণে কোন সুস্থ আবেদন পৌঁছায় না।
যে দেশের রাষ্ট্রনায়করা একটার পর একটা ভুল করেও ‘গদি’ ছেড়ে দেয় না—সে দেশের শাসন-যন্ত্র কি করে অবিকল থাকে? সবাই জানে—এ শাসনে কাউকেই ভয় করবার নেই—‘সরি’ বলেই তরে যাওয়া যায় সব ভুল-ভ্রান্তি করার অন্যায় থেকে।
তুমি যখন অসমীয়াদের গুণগানে পঞ্চমুখ, একশ্রেণীর অসমীয়া নেতার গায়ের অপরাধের ধূলাে ঝাড়তে ব্যস্ত, কই তখন ত একটি কথাও বললে না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়িতে হরেশ্বর গােস্বামীকে রক্ষা করতে যে দৃঢ়তা দেখায়, সে বিষয়ে? বলতে ত’ পারলে না সত্যাশ্রয়ী মহাত্মার শিষ্য যে আসামে যদি এই ভাবে দৃঢ়তা দেখাত শাসন কর্তৃপক্ষ, তা হলে বহু অমূল্য জীবন নষ্ট হত না, নারীরা হত না লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা, শিশুদের ভয়ার্ত চীৎকার ও বাঙ্গলাভাষী ভারতীয়দের ভাগ্যজ্বলা আগুনের লেলিহান শিখায় আসামের আকাশ বাতাস হত না লালে লাল।
তাই বলি পণ্ডিত নেহরু, তুমি ভুল করছ, ভুল করছ তুমি মাত্র একটা নয়, দুটো নয়—অনেক, অনেক।
এতে তােমার জন্য আমার দুঃখ হয়—যে তুমি বিদেশে নানা রাষ্ট্রের বহু মানুষের বন্ধু, সেই তুমিই তােমার আচরিত নীতির জন্য দিনের পর দিন দেশের লােকের মনের শ্রদ্ধার আসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। এ যে তােমার কত বড় পরাজয় নেহরু! তাই বলি নেহরু, অনেক ভুলের মালা গলায় পরেছ, এবার সে মালা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে হয় দৃঢ় হও, শক্ত হাতে শাসন যন্ত্র চালাও, নতু মন্ত্রীত্বের মসনদ হেলায় ছেড়ে নেমে এসো, নেমে এসাে জনতার মাঝে, তাদের মনের মাঝে ধ্বনিত করাে, রণিত করাে নবজাগরণের সঙ্গীত। যে সঙ্গীতের তালে তালে তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সজাগ হয়ে ভারতকে তার বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করে সার্থকতার পথে এগিয়ে নেবায় সঙ্কল্প নেবে। অনেক ভুল করেছ—এ শুধু আমার একার স্বগতােক্তি মাত্র নয়, এ গণতন্ত্রী দেশের অনেকের মতেই এ সত্য, উক্তি।
*** *** ***
হল্লা করতে করতে শুভ্রেন্দুকে টেনে হিঁচড়ে অদূরের গ্রামের দিকে নিয়ে চলে গেল। ওদের সােরগােলের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেলে পথের দু’দিকের নিচ্ছিদ্র বনদেশ থেকে বেশ ক’জন ভয়ার্ত নারীপুরুষ, কিশােরী-বালিকা একে একে বেরিয়ে এলো। লােকালয় ছেড়ে পলায়নপর মানুষগুলাে বনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বনের কাটা গাছের আচড়ে ওঁদের দেহের এখানে ওখানে রক্ত ঝরছে। ওঁদের সবার চোখেমুখেই ভয় ভয় ভাব। কপালে কপালে উদ্বেগের কুঞ্চন। দুর্বৃত্তরা শিবানীর যে হাল করে গেল—তার বুকে যে আঘাত হেনে গেল শুভ্রেন্দুকে ছিনিয়ে নিয়ে, তা সবই দেখেছে ওরা। আর তারা তাদের ভয়াল অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে শিবানীর ওরা কি সর্বনাশ করল। ওদের দেখে শিবানী তার অসুস্থ মস্তিষ্কের নির্দেশে ভীতচকিত হয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। ওদের সঙ্গের মেয়েরা এগিয়ে গিয়ে “বাবা বাছা” বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে সঙ্গে যেতে রাজী করালাে। অবশেষে ওরা বিহবল শিবানীকে সংগে নিয়ে ওদের পলায়নের বর্বরতা এবং ভীষণতার পথে এগিয়ে চলল। পালাতে হবে ওদের নিষ্ঠুরতার তাণ্ডব-নৃত্যে নেচে ওঠা ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে।
কিছুটা দূরেই রেল ষ্টেশন—ওদের গতি সেই দিকে। নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ওরা পালাতে চায় মৃত্যু মহােৎসবে উল্লসিত আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে। শিবানী আজ ওদের সহযাত্রী, হােক সে অসমীয়াভাষী মেয়ে-তবু সে সর্বহারা—তার আপন অধিকার থেকে সেও বাঙ্গলাভাষীদের মতই চ্যুত, তাড়িত, বঞ্চিত।
চলতে চলতে এক এক সময় হঠাৎ থেমে পড়ে শিবানী। তারপর অসুস্থ মস্তিষ্কের খেয়ালে ডান হাতটা সামনের দিকে প্রসারিত করে ধরে চোখে মুখে একটা অদ্ভুত কাঠিন্য এনে বলে ওঠে—
—ঠাস, ঠাস্ ! বেঙ্গলী মারিম! অসমীয়া মারিম। এ কথা বলে আবার ও শান্ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আবার স্বাভাবিক ও সহজ হয়ে পথ চলে।
রেল ষ্টেশনের আর বেশী বাকি ছিল না। ছিন্নমূল মানুষগুলাের ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে—কেননা এইটুকু পথে আর কোন উন্মত্ত জনতা মৃত্যুর পরােয়না এনে তাদের গতিরােধ করেনি।
হাজার হাজার বাংলাভাষী উদ্বাস্তু আজ আসাম রাজ্যের মৃত্যু সীমান্ত ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে সন্নিহিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। ট্রেনের কামরাগুলাে ভয়ার্ত, হৃতসর্বস্ব, বিহ্বল, ছিন্নমূল মানুষে ঠাসা একবার ওদের অনেকেই উনিশ শ সাতচল্লিশে পাওয়া স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে বয়ে ভারতীয় নাগরিক হতে ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিল। সেই ওরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সংবিধান স্বীকৃত মৰ্যাদা পেয়েছে। তবু ভারতের সীমানাতেই ওদের আবার সাজতে হয়েছে পুনরুদ্বাস্তু।
যে পশুত্বপরিকীর্ণ রাজ্য ছেড়ে কুকুর বেড়ালের মত তাড়া খেয়ে ওরা চলে আসছে সে রাজ্যের পলিটিশিয়ানদের এতে লজ্জা নেই। সে রাজ্যের এক শ্রেণীর ছাত্র-গুণ্ডারা এতে শ্লাঘা বােধ করেছে ও করছে। আর যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ওরা দাবি করতে পারে পূর্ণ নিরাপত্তা, সেই কেন্দ্রীয় সরকার দলীয় স্বার্থ তোলে এমন নির্মম বীভৎস ঘটনার বিচার বিবেচনা করার পালায় ব্যস্ত। তাই এই সদ্য পুনরুদ্বাস্তু হতভাগ্যদের ভার নিতে এগিয়ে এলাে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ বিভাগ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সজ্জন সাধুবৃন্দ এবং পশ্চিমবঙ্গ রেডক্রসের সেবকবৃন্দ ও অন্যান্য আরও কটি ছােট বড় সেবা প্রতিষ্ঠান।
উদ্বাস্তুদের জন্য সারি সারি ছাউনি পড়েছে বঙ্গ-আসাম সীমান্ত সহর আলিপুর দুয়ারে। ছাউনির মাঝে মাঝে সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলােব অফিস-ক্যাম্প। তাতে টাঙ্গানাে আছে প্রতিষ্ঠানের নামােৎকীর্ণ লাল বা সাদা ফেষ্টুন। ভলান্টিয়াররা ষ্টেশনের দিক থেকে আসামে বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে তাড়া খাওয়া নিঃস্ব নরনারীদের দলকে সঙ্গে এনে পুলিশ ও ত্ৰাণবিভাগের অফিসারদেব কাছে নাম লিখিয়ে ছাউনিতে নিয়ে যাচ্ছে।
ভলান্টিয়ারদের কেউ কেউ লঙ্গরখানার সামনে সারবন্দি হয়ে দাঁড়ানাে সব থেকেও ভিক্ষুক হওয়া মানুষদের হাতের পাত্রে খীচুড়ি পরিবেশন করছে। কোন কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের তাঁবু থেকে বাচ্চাদের জন্য বিলােন হচ্ছে পাউডার গােলা দুধ। কোন ক্যাম্প থেকে আবার বিতরণ করা হচ্ছে চাপাটি-তরকারী। কোথাও বা এক বস্ত্রে চলে আসা নারীপুরুষদের মধ্যে বিলােনাে হচ্ছে শাড়ী-ধুতি। চারদিকে অদ্ভুত এক কর্মব্যস্ততা। আর্তের সেবায় দয়া হৃদয় মানুষের মহত্বম প্রচেষ্টা।
হঠাৎ এক সময় ত্রাণবিভাগীয় ও পুলিশ কর্মচারীরা শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। কেননা নবউদ্বাস্তুদের অবস্থা পরিদর্শনে কলকাতা থেকে এসেছেন ত্রাণ বিভাগের সেক্রেটারী সিভিলিয়ান মিঃ বাসু। সঙ্গে তার জেলা ও মহকুমা শাসক, পুলিশের বড়কর্তা, জেলা মেডিক্যাল অফিসার প্রভৃতি। অফিসারবাহিনীসহ সিভিলিয়ান মিঃ বাসু ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন ভয়নীল মানুষগুলাের নাকাল হওয়া অবস্থা। অফিসাররা পরস্পর আলােচনা করেন, কী ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হলে তবে মানুষ নিজের আশ্রয় ও জিবীকা নিশ্চয়তা ছেড়ে এভাবে চলে আসতে পারে অনির্দিষ্ট আশ্রয়ে।
ত্রাণ-বিভাগীয় অফিসারদের কাছে সেবাব্রতীরা তখন সবে আসা একগাড়ী যাত্রীকে নিয়ে এসেছে নাম-ধাম লেখাতে। সেখানে এগিয়ে গিয়ে মিঃ বাসু শুনতে চেষ্টা পান নিজ নিজ মুখে বলা ওদের করুণ কাহিনী। হঠাৎ ওঁর দৃষ্টি ঠিকরে পড়ে ওদের মধ্যে চোখে মুখের স্বাতন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিবানীর ওপর। দেখামাত্র যেন মিঃ বাসু চমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ তাঁর দৃষ্টি সরাতে পারেন না শিবানী নামের মেয়েটির মুখ থেকে। তাঁর মননিভৃতে তখন অবচেতন মনের অথৈয়তা থেকে একটা বেদনাময় স্মৃতি তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে ভেসে উঠেছে। হ্যাঁ, অবিকল এক। চিবুকের ঠিক বাঁ দিকের তিলটা পৰ্যন্ত এমন কি। মিঃ বাসুর একমাত্র সন্তান মলি। সাতরাজার ধন এক মাণিকের মত যেন মহা আদরিণী সে মেয়ে। বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে মাবাবার আশ্রয়স্থল। আদর আর আদর। সােহাগ আর সােহাগ। কোন সময়ই মিসেস বাসু মেয়েকে চোখের আড়াল করেন না। মিঃ বাসু কর্মস্থল থেকে ফিরে এসেই মেয়েকে নিয়ে পড়েন। সঙ্গে আনেন পুতুল-লজেন্স-টফি। আজ যে খেলনাটা নতুন, কাল সেটা আর তার জীর্ণতা নিয়ে খুকু মলির মন পায় না। দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে মলি। শৈশব থেকে বাল্য, বাল্য থেকে কৈশাের, কৈশাের থেকে যৌবন। এই যৌবনচঞ্চল যুবতীকে উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করতে হবে। সিভিলিয়ান মিঃ বাসু এমন সমাজের মানুষ যে সমাজে তাঁর মেয়ের উপযুক্ত পাত্র পেতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
মহাধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল মলির।
মি: ও মিসেস বাসুর হৃদয়-সমুদ্রে বিচ্ছেদের ঝড় বইয়ে মলি স্বামী-সঙ্গিনী হয়ে চলে গেল বিদেশে।
ক্রমে ক্রমে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর বিলীন হয়ে যায় কাল সমুদ্রে। আসন্ন সন্তান সম্ভবা মলিকে মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় নিয়ে আসা হল। সব সময় মলিকে আগলে থাকেন মিসেস বাসু। দিনরাত তাকে খুশী রাখার কত চেষ্টা। প্রসূতির পরিচর্যার জন্য বিদেশে পাশ করা লেডিডাক্তারের তত্বাবধানে দু’জন অভিজ্ঞ ধাত্রী দিনরাত কাজ করে। পান থেকে চূণটুকু খসবার উপায় নেই।
অবশেষে দিন ঘনিয়ে আসে। ফরেন সার্ভিসে কাজ করা জামাই ‘কেবল’ পেয়ে ছুটে আসে ফ্লাই করে। এক বর্ষণ-ক্লান্ত রাত্রে প্রসববেদনায় আচ্ছন্ন হয় মলির সারা দেহ। শহরের সবকটি বড় বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে নার্সিংহােমে ডাকা হ’ল নির্বিঘ্নে প্রসব করাবার তদারক করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরল ও স্বাভাবিক পথে পথ করে মাটির পৃথিবীতে এলাে না সে শিশু। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সমবেত সিদ্ধান্তে স্থির করেন অপারেশনে করতে হবে। সিজারিয়ান অপারেশান।
ব্যবস্থার কোন ত্রুটি থাকে না।
লেবার রুমে ছুরি-কাঁচি হাতে ডাক্তাররা আবার পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে দু’জনকে বাঁচানাে যাবে না। বিশেষ করে শিশুকে বাঁচানো সহজ হবে কিন্তু প্রসূতিকে নয়। মিঃ বাসু, মিসেস বাসু ও মলির স্বামী সমবেতভাবে মলির প্রাণভিক্ষা চায় ডাক্তারদের কাছে। চেষ্টায় লেগে যান তারা চিন্তিত মুখে। কিন্তু কোন ত্রুটি থাকা সত্বেও শেষ রক্ষা হয় না। বিষন্ন মুখে ডাক্তাররা লেবার রুম থেকে বেরিয়ে যান ব্যর্থতার বােঝা বয়ে।
সংবাদটা শােনামাত্র পাগলিনী প্রায় মিসেস বাসু মলির নিস্পন্দ নিথর দেহের উপর আছড়ে পড়ে সংজ্ঞা হারান। আর মিঃ বাসু আকস্মিক এ আঘাতে যেন পাথর হয়ে যান।….
ভাবতে ভাবতে মিঃ বাসুর চোখ ফেটে যেন জল আসতে চায়। সরকারী কর্মচারীরা সাহেবের ভাবান্তর লক্ষ্য করে পরস্পরের মুখে চাওয়া চাওয়ি করে। উদ্বাস্তু জনতার একটি অংশ কৌতূহলী হয়ে অফিসার পরিবৃত মিঃ বাসুকে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়ায়। বেগতিক বুঝে জেলা শাসক মিঃ বাসুর কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় ডাকেন—
—স্যার!
শােনামাত্ৰ মগ্নাবস্থা থেকে যেন চেতনে ভেসে ওঠেন মিঃ বাসুর মন। ফিরে আসে সম্বিৎ। বলেন:
—এই মেয়েটিকে একবার কাইণ্ডলী ইন্সপেকশন বাংলােয় আমার কাছে নিয়ে আসবেন। আর সম্ভব হলে ওর সঙ্গীদের কাছ থেকে ওর হিস্ট্রিটা জেনে নেবেন। কি করে এলাে, কেন এলাে, কোথা থেকে এলাে—এই আর কি।
—আচ্ছা স্যার।
সম্মতি দেয় নিম্নতন অফিসার। আশ্বাস পেয়ে আশ্বস্ত হওয়া সিভিলিয়ান মিঃ বাসু আবার পরিদর্শনের কাজে ক্যাম্পে ক্যাম্পে এগিয়ে যান। তাঁকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলে এক পাল ঘােট বড় অফিসারবাহিনী।
তহিততদ্বির শেষ করে মিঃ বাসু যখন ইন্সপেক্শন বাংলােয় ফিরে আসেন তখন অতি কষ্টে দু’তিনজন সরকারী কর্মচারি শিবানীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একরকম বল প্রয়ােগ করেই ধরে আনে। মিঃ বাসু ওর কাছে এগিয়ে আসেন। এমন সময় শিবানী আবার তার অসুস্থ মস্তিষ্কের নির্দেশে ডান হাতটা সামনে প্রসারিত করে। মুখের ভাব কঠিন করে। পরক্ষণেই হিংস্র স্বরে বলে ওঠে—
—ঠাসঠাসঠাস্। বেঙ্গলী মারিম, অসমীয়া মারিম।
শিবানীকে উদ্ধার করে আনা উদ্বাস্তুদের জনৈক মুখপাত্র প্রত্যক্ষদশীর বিবরণ দেয়। কিন্তু সে শিবানীর নাম বা অন্য কোন পরিচয় জানাতে পারে না।
মিঃ বাসু সহানুভূতিভরে শিবানীর কাছে এগিয়ে আসেন। মাথায় আশ্বাসের হাত বুলিয়ে দেন। স্নেহসিক্ত কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করেন—
—তােমার নাম কি মা?
শুনে শিবানী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার ডাগর ডাগর চোখ মেলে চায়। কপালের রেখায় কুঞ্চন পড়ে। চোখের মণি ঘুরায় ও। দৃষ্টি যেন ভাষাহীন, শূন্য। মুখে ভীতিবিহ্বল ভাব ভেসে ওঠে। পরক্ষণেই ভয়ার্ত চীৎকার করে বলে ওঠে—
—না-না, যেওনা, তােমায় ওরা মেরে ফেলবে, মেরে ফেলবে। কথার শেষে হাউ হাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে শিবানী।
আলিপুরদুয়ার থেকে একটি সরকারী জীপ হু-হু বেগে ছুটে চলে উত্তরবঙ্গের সুপরিচিত বিমানবন্দর বাগডােগরার দিকে। সিভিলিয়ান মিঃ বাসু তাঁর পরিদর্শনের কাজ শেষ করে এবার একা ফিরছেন না কলকাতায়। সঙ্গে অসুস্থ মস্তিষ্ক শিবানী। গাড়ী চলার ঝাকানির দোলায় শিবানী ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়া শিবানীর মাথাটা ঢলে পড়েছে মিঃ বাসুর কাছে। অতি যত্নে বাহু বেষ্টনে তিনি সাবধানে ধরে আছেন শিবানীকে। পাছে পথে শিবানী বেশীরকম উত্তক্ত করে, তাই তিনি নিজের বেয়ারা আন্দালী ছাড়াও দুজন অতিরিক্ত সরকারী লােক সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মােটর-পথে তাদের তেমন সহায়তার প্রয়ােজন হল না।
নির্দিষ্ট জীপটা শিলিগুড়িতে এসে পৌঁছুলে মিঃ বাসু মিসেস বাসুকে দমদম্ এয়ারােড্রোমে আসতে বলে একটা টেলিগ্রাম মুসাবিদা করে সঙ্গে আসা জনৈক ত্রাণ বিভাগীয় কর্মীকে দিয়ে বলেন:
—এটা এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম করে দিয়ে আপনি এয়ারােড্রামে চলে আসুন, কেমন?
—আচ্ছা স্যার।
সম্মতি জানিয়ে নেমে চলে যান ভদ্রলােক। আরও কিছুটা পথ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে সরকারী জীপ গাড়ীটা বাগডােগরা এয়ার ফিল্ড-এ এসে হাজির হয়।
আকাশে উড়ে আসা একটা কারগাে প্লেনের তীব্র শব্দে শিবানীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। হঠাৎ চমকে উঠে জেগে ওঠে ও। জেগেই শিরদাঁড়া সােজা করে হুডখােলা জীপের মধ্যে উঠে দাঁড়ায়। কঠিনভাবে ডান হাতটা সামনের দিকে টানটান করে ধরে বলে ওঠে—
—ঠাস! ঠাস! বেঙ্গলী মারিম। অসমীয়া মারিম।
জীপের অন্যান্যদের মত মিঃ বাসুও শিবানীর মুখে দৃষ্টি উঠিয়ে চেয়ে ছিলেন এতক্ষণ। তিনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে শিবানীর পিঠে সান্ত্বনার হাত চাপড়িয়ে বলেন:
—মারে, এবার নামতে হবে। চল্ নেমে পড়ি।
চোখ পাকিয়ে ভাষাহীন শূন্য দৃষ্টিতে মিঃ বাসুর চোখ মুখে দেখে নিয়ে কি ভেবে যেন শিবানী যান থেকে নেমে পড়ে। মিঃ বাসুও যান ত্যাগ করে শিবানীর পাশে এসে তাকে ডান হাতে স্নেহভরে জড়িয়ে ধরে প্রতীক্ষালয়ের দিকে এগিয়ে চলেন।
সগর্জিত নির্দিষ্ট প্লেনটা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দমদম বিমান বন্দরের রানওয়েতে নিজেকে নামিয়ে নিয়ে ছুটে চলে। অবশেষে তার গতি হয় স্তব্ধ। এয়ারােড্রামের কর্মীরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উঁচু সিঁড়িটা নিয়ে এসে যথাস্থানে লাগিয়ে দেয়।
একে একে যাত্রীরা নেমে আসেন ব্যোমযান থেকে। মিঃ বাসুও শিবানীসহ নামেন এক সময়। নেমে এগিয়ে চলেন সেই দিকে যেখানে অনেকগুলি অধীর মুখ-চোখ প্রতীক্ষারত। প্রতীক্ষমানদের মধ্যে মিসেস বাসুর মুখটা মিঃ বাসুর চোখে পড়ামাত্র তাঁর মনের মধ্যে একটা দুর্বলতা যেন মােচড় দিয়ে ওঠে।
শিবানীসহ এগিয়ে মিসেস বাসুর মুখামুখী এসে যান তিনি। শিবানীকে দেখামাত্র মিসেস বাসুর মাতৃহৃদয়ের অথৈয়তায় সে কি এক আনন্দের তােলপাড়! ক্রমে ক্রমে সেই আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ে তার চোখে মুখে। ঠোঁটদুটো স্পন্দিত হয় আবেগে। ধীরে ধীরে প্রসারিত করেন আশ্বাসভরা মাতৃবাহু। হারানিধি ফিরে পাওয়ার মত শিবানীকে বুকে টেনে নেন জননী হৃদয়ের অসীম আকুতিতে। এমনই চেয়েছিলেন মিঃ বাসু। এই রকম একটা মিলন মধুর দৃশ্য কল্পলােকে রূপ পেয়েছিল বলেই তিনি শিবানীকে সঙ্গে এনেছিলেন। ভেবেছিলেন প্রৌঢ়া মিসেস বাসু দীর্ঘ বার বছরে যে শোকের উষর মরুভূমিতে দিগভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেখানে মলি সদৃশ শিবানীর মুখ বুঝি সৃষ্টি করবে ক্ষীণ আশ্বাসের ওয়েসিস। তাই মিসেস বাসুর মাতৃবুকে আলিঙ্গিত শিবানীর দিকে চেয়ে সিভিলিয়ান মিঃ বাসুর চোখ কেন যেন দুটো আপনা থেকেই আদ্র হয়ে ওঠে।
*** *** ****
আমার মনের একান্ত প্রকোষ্ঠে, পণ্ডিত নেহরু, তােমার শাসনে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের যে হতাশ চিত্র ভেসে ওঠে তাইত স্বতােৎসারিত হচ্ছে আমার স্বগতােক্তিতে। শান্তিপূর্ণ অহিংস সংগ্রামে যে স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত তার শাসনতরণীর কর্ণধাররা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যে বাঙ্গালী ও বাংলা স্বাধীনতা সংগ্রামের যজ্ঞানল প্রজ্বলিত করেছিল নিজের বিপ্লবী সত্তাকে “ওঁ স্বাহা’ বলে আহুতি দিয়ে, সেই বাঙ্গালীকে আজ শাসন ও শোষণে কোথায় ঠেলে দিচ্ছ তােমরা, পণ্ডিত নেহরু? এত বড় মারণ-যজ্ঞ করে যে বাঙ্গলাভাষীদের ভীষিত করে তাড়ালো অসমীয়া রাজনীতিকরা সেই বাঙ্গলাভাষীদের সাহায্যের জন্য আজ পর্যন্ত কোন যুক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার উপুড়হস্ত না হয়ে আছে? খণ্ডিত বাংলার বুকে চাপা উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গের শাসন ও সমাজ টলটলায়মান, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের মনে কি একটুও করুণা জাগল না সহযােগিতার হাত বাড়াতে? কেন? কোন্ মানসিকতায় কেন্দ্রীয় ত্রাণবিভাগ আজও এগিয়ে আসেনি আসাম আগত উদ্বাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে? কেন কেন্দ্রীয় সরকার আজও আসাম সরকারকে বলতে সাহসী হয় না যে, যে বীভৎস হত্যালীলার ভয়ে ভীত হয়ে অসমীয়া বাঙ্গালীরা পালিয়ে এসেছে, তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সেই রাজ্যেরই সরকারের? কেন? পণ্ডিত নেহরু, তুমি নিজে যদি উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলি ঘুরে দেখে তাড়িত মানুষগুলির মুখে চোখে লেগে থাকা ত্রাস ও ভয়ের ভাষা পাঠ করতে চেষ্টা করতে, তাহলে বুঝতে কি অবস্থায় পড়লে মানুষ তার স্থিতু হওয়া আবাসস্থলকে অবহেলায় ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়।
যদি তুমি বুঝতে চাইতে তবেই বুঝতে পারতে কী নিদারুণ অর্থনৈতিক অবস্থার চাপে পড়ে স্বাধীনতার বলি হওয়া বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত দিনের পর দিন অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু শাসকদের সে সহমর্মিতা কোথায়, কোথায় সেই আন্তরিক আকুতি? সমাজের ও শাসনের যত পঙ্কিলতা তাতে কেবলি জোড়াতালির ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে চিরস্থায়ী দুর্গন্ধ দূর করা যায় পণ্ডিত নেহরু। এজন্য সরল ও সবল নেতৃত্ব চাই—যে নেতৃত্বে মানুষের যা কিছু মহৎ গুণ তাকে উড়িয়ে দেবার ও জীবনের যা কিছু কল্যাণ তাকে উজ্জীবনের পথে পথ দেখাবার প্রয়াস থাকবে। সে প্রয়াস কি তুমিও করতে পারতে না নেহরু? জাতি কি তােমার কাছেও তাই আশা করেনি? করেছিল। করেছিল বলেই আজ তােমার এত জনপ্রিয়তা, করেছিল বলেই তুমি আজ ভারতরত্ন সম্মানে হয়েছ ভূষিত। কিন্তু সে রত্নের উপরে আজ যখন একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের ধূলার আস্তরণ পড়ছে তখন দেশের দীনতম এক জাতীয়তাবাদী লেখক হিসাবে আমার মনেও যে ব্যথার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে নেহরু।
পণ্ডিত নেহরু, তুমি তােমার জনপ্রিয়তার মেঘপুঞ্জে ভারতের রাজনৈতিক আকাশকে আচ্ছন্ন করে একের পর এক যে ভুল করে চলেছ তার সুদূরপ্রসারি পরিণতি ভেবে আমি শঙ্কিত হচ্ছি। আর সেই ভুলের হাতছানি থেকে যাতে তুমি তথা কেন্দ্রীয় সরকার তথা ভারতীয় জাতি রক্ষা পায়, সেই জন্যই আমি মােগল আমলের বার ভুইঞাদের সময় থেকে আরম্ভ করে বিপিনচন্দ্র পাল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কমরেড এম. এন. রায়, শরৎচন্দ্র বসু, ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় প্রভৃতি নেতারা যেমন করে কেন্দ্রের অসঙ্গত জেদ ও প্রভুত্বের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ ঘােষণা করে প্রকৃত বিরােধী নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন-মন্বন্তরে না মরা’ ‘মারি নিয়ে ঘর করা বিরােধী ভাগ্যরূপ বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এই বাংলা তথা বাঙ্গালীর মধ্য থেকে আবার তেমনি এক শক্তিশালী সৰ্বভারতীয় বিরােধী নেতার আবির্ভাব কামনা করি।
*** *** ***
শুভ্রেন্দুকে নিয়ে তখন অভিনীত হচ্ছে আর এক নাটক। সে নাটকের যবনিকা উঠলে প্রথম দৃশ্যেই যে রসের অবতরণা হ’ল সে বীভৎস রস। সে রস নিষ্ঠুরতার, নির্মমতার। দুর্বৃত্তরা ওর দেহের উপর অজস্রধারায় বর্ষণ করতে লাগল কীল চড় ঘুষি লাথি। একটি অসুস্থ ভদ্ৰদেহ সেই পাষণ্ডতা আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারে? এক সময় আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ক্ষতবিক্ষত দেহ ওর সংজ্ঞা হারায়। অবহেলায় পড়ে যায় ওর দেহ পথের বুকে।
ওদের পরিচালনা করছিল, গৌহাটী মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র এবং বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের অন্যতম সক্রীয় বিশিষ্ট সদস্য বরদাকান্ত বরদলৈ। সে হাস্যকর আন্দোলনের নামে কুকর্মের কমরেডদের অসমীয়া ভাষায় বলে—
—এই, আর বেশী মেরনা বঙ্গালটাকে। মরে গেলে ত সব চুকেই গেল। ওকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
এ কথা শুনে ওদের অনেকেই এক সঙ্গে প্রশ্ন করে:
—সে কি রকম?
—আগে এটাকে নিয়ে চল আমাদের বাড়ী। সেখানে ঘরে ওকে বন্দী করে রেখে সবাই মিলে বৈঠকে বসে ঠিক করি কি ভাবে কাজ করা যাবে।
—বেশ, তাই হােক, তাই হােক।
সমবেত স্বরে অনেকগুলো কণ্ঠ চেঁচিয়ে ওঠে। অচৈতন্য শুভ্রেন্দুর দেহটাকে দু’তিন জন তরুণ ধরাধরি করে তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওদের পাণ্ডা যুবক তাদের বাধা দিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে:
—বঙ্গালটাকে আবার অত যত্ন করে নিতে হবে, ছে: তার চেয়ে ওর একটা পা ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চল।
—ঠিক, ঠিক।
সবাই উল্লসিত হয়ে ওঠে। ওদের মধ্য থেকে একজন অতি উৎসাহী সগর্বে এগিয়ে এসে শুভ্রেন্দুর ডান পাটা ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে নির্দিষ্ট পথে। সেই যুবকের পিছনে পিছনে পশুতার উল্লাসে উন্মত্তপ্রায় জনতা হৈ চৈ করতে করতে জহলাদের আনন্দে উদ্বেল হয়ে এগিয়ে চলে।
সােরগােল শুনে বরদাকান্তের অশীতিপর প্রায় অথর্ব ঠাকুরমা নাতনি বিনীতাকে ডেকে বার্ধক্যকম্পিতকণ্ঠে বলেন :
—ওরে বিনী, দেখতাে বাইরে কিসের হৈ চৈ?
—যাই।
রান্নাঘরে ভাত কাত করতে করতে সাড়া দেয় বিনীতা। হাতের কাজ শেষ করে কোমরে জড়ানাে আঁচল খুলে তাতে ভিজা হাত মুছতে মুছতে পথের দিকে বেরিয়ে যায়। একটু পরেই পথের চলমান ভীড়টা এগিয়ে আসে। আগে আগে তার ওদের গ্রামের সবচেয়ে বখাটে ছেলেটাকে নির্মমভাবে একটা রক্তাক্ত দেহ অবহেলাভরে টেনে আনতে দেখে বিনীতার মনটা ব্যথার, বিষন্নতায় ভরে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস করে না। কেননা ক’দিন হল তার শিক্ষিত দাদা যেভাবে দিনের পর দিন এক হিংসার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তা সে অবাক হয়ে দেখছে। কিন্তু বাবার অবর্তমানে একমাত্র পুরুষ অভিভাবক তার দাদাই। তাই তার কাজে বাধা দেওয়া বা প্রতিবাদ করা তার মত মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আজ যে বীভৎস খেলায় জ্যান্ত একটা মানুষকে মড়া কুকুরের মত হেলায় টেনে আনছে তা দেখে তার মনের রুচি যেন সচীৎকারে ধিক্কার দিয়ে উঠল।
শুভ্রেন্দুর দেহটা টেনে এনে প্রথমে ওদের বাইরের উঠানে ফেলতে তার ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে চেয়ে বিনীতার নরম নারীমন দুলে উঠল। বরদাকান্তের কাছে এগিয়ে গিয়ে শুধালাে:
—কে দাদা, কি করেছে লােকটা?
—ওই একটা বঙ্গাল। একটা অসমীয়া মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।
বিনীতাকে আর কিছু না বলে বরদাকান্ত সঙ্গীয় কয়েকজনের দিকে চেয়ে বলল :
—ধর তােরা ওর ঠ্যাঙ আর হাতদুটো। চ্যাংদোলা করে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিই।
বরদাকান্তর সিদ্ধান্ত মতই তার সাকরেদরা শুভ্রেন্দুর জ্ঞানহারা দেহটা ঘরের মধ্যে বয়ে নিয়ে অবহেলাভরে ধপ করে ফেলে দিল। সে শব্দ যেন বিনীতার নারী মনে ঐ ভাবেই আঘাত করল। ওরা বেরিয়ে এলে বরদাকান্ত ঘরের দোর টেনে দিয়ে তার কড়ায় তালা লাগিয়ে চাবিটা বিনীতার হাতে গুজে দিয়ে বলল:
—খুব সাবধান, বঙ্গালদের মত ধূর্ত জাত কিন্তু আর নেই। যদি জ্ঞান ফিরে এলে জলের জন্যে চেঁচায়, দিবি। কিন্তু বেরিয়ে যেন পালায়। অবশ্য পালাবার শক্তি ওর আর নেই। যা মার পড়েছে—দিন কয়েক বাছাধনের উঠবার মুরােদ থাকবে না।
কথা শেষ করে দলবল সহ বরদাকান্ত চলে যায় বাইরের ঘরে। সেখানে তাদের বৈঠক বসে। বরদাকান্ত বলে:
—ভাইসব। তােমাদের অনেকেরই ইচ্ছা যে বঙ্গালটাকে একেবারে জন্মের মত মেরে ফেলি। আমার ইচ্ছাও তাই। কিন্তু বেঁচে থেকে যতটা যন্ত্রণা সইতে পারে ও সহ্য করুক। তাতে ওকে আরও বেশী শাস্তি দেওয়া হবে। যে কাজ ও করেছে এইটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। এছাড়াও কিন্তু আমার মাথায় আর একটা মতলব এসেছে।
—কি? কি?
প্রশ্ন করে ওদের দু’তিন জন সমস্বরে।
—মতলবটা হ’ল এই, বঙ্গালটার বাবার কাছে ওকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে মুক্তিপণ হিসাবে হাজার পাঁচেক টাকা চেয়ে টেলিগ্রাম করে দেওয়া। কেননা বঙ্গালদের একেবারে উৎখাত করতে হলে ওদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিতে হলে প্রচুর পেট্রোল চাই। তা ছাড়া অসমীয়া পুলিশদের প্রয়ােজন হলে ঘুষ দিয়ে অস্ত্র যােগাড় করতে দেখলে না পাগলী মেয়েটা মাত্র একটা রিভালভার দিয়েই আমাদের কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল? এখন বল, এ ব্যাপারে তােমাদের কি মত?
—টাকার আমাদের দরকার ঠিকই, কিন্তু ওকে তাই বলে প্রাণে না মেরে ছেড়ে দেব?
ওদের একজন বলে।
—ছেড়ে দেব, এ কথা ত বলিনি। টাকার জন্য আটকে রাখছি। তারপর ওর বাবা টাকা নিয়ে এলে তখন টাকাও পাওয়া যাবে আর সেই সঙ্গে বাপ-বেটা দু’জনকেই এক সঙ্গে…বুঝলে না? ” …..
শেষটুকু মুখে না বলে বরদাকান্ত হাতের পাতা নিজের গলার কাছে এনে এমন ভঙ্গী করে যাতে সবাই বুঝল যে সে কি করতে এসব শুনে ওদের এক কলেজে পড়া ছেলে উচ্ছসিত হয়ে বলেতে চাইছে।
—দি গ্রাণ্ড আইডিয়া!
—এখন চল, বড়গোঁহাইদার কাছে পরামর্শ করে আসি।
বরদাকান্ত বলল। বড়গোঁহাই স্থানীয় ফাঁরীর পুলিশ অফিসার। আসাম থেকে বাঙ্গলাভাষীদের বিতাড়ণে তাঁর সায় ও সমর্থন সর্বাধিক। তাই বরদাকান্ত তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে যা কিছু সলাপরামর্শ করুক, কেন সব কিছু বড়গোঁহাইকে বলে সৎপরামর্শ গ্রহণ করে থাকে।
সামনের দিকের দরজা বন্ধ করে বরদাকান্ত ভেতরের বাড়ির দিকে আসছে বুঝে আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনতে থাকা বিনীতা এক ছুটে চলে যায় ঠাকুরমার কাছে। ঠাকুরমা তার ছানি পড়া চোখে বিনীতাকে আঁচ করে বলেন :
–কিরে, বিনী, শুনলি, কিসের এত হৈচৈ?
—হ্যাঁ, শুনলাম।
—কি?
—দাদারা এক বঙ্গালী ছেলেকে মেরে আধমরা করে টেনে হিঁচড়ে আমাদের ঘরে এনে আটকে রেখেছে।
—জানিনে বাপু, কি যে করছে ওরা কালে কালে।
—তাই ত আমিও বলি।
—তা, দেখতে কেমন বলত ছেলেটি? ছােটলােক না ভদ্দর লােক।
—মুখচোখের কি আর বাকী আছে কিছু, রক্তে ধূলায় কাদায় একাকার। বােঝ না, এতটা পথ হেঁচড়ে নিয়ে এসেছে।
—তা যা না, ছেলেটার শুশ্রুষা করগে একটু। আমার ত” শরীরে কিছু নেই, নইলে আমিই যেতাম।
—কিন্তু দাদা যদি বকে?
শঙ্কিত স্বরে বলে বিনীতা।
—বকে, বকুনি শুনবি। তাই বলে যে মানুষটা মরতে বসেছে গেরস্তর ঘরে তাকে একটু সেবা করবি নে?
বিনীতার মনের একান্তে আহত মুমূর্ষ মানুষটাকে একটু সেবা দেবার একটা আকুতি অনেকক্ষণ থেকেই চনমন করছিল, কিন্তু দাদার ভয়ে সাহস পাচ্ছিল না। ঠাকুরমার আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে ও এক বাটি জল, একটু নেকড়া নিয়ে দোর খুলে ঢুকলে গিয়ে শুভ্রেন্দু যে ঘরে বন্দী, সেই ঘরে। ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে খিল তুলে এগিয়ে গেল অবহেলায় পড়ে থাকা শুভ্রেন্দুর মাথার কাছে। জলের বাটিতে ন্যাকড়া ডুবিয়ে ওর মাটি মাখানাে রক্তাক্ত মুখটা পরিস্কার করতে লেগে গেল। ক্রম ক্রমে অপরিছন্ন ক্ষতবিক্ষত বন্দীর মুখটায় একটা দিব্যকান্তি সুপুরুষ যুবার চেহারা ভেসে উঠল। সে চেহারাটা বিনীতার মনের মধ্যে গিয়ে যেন ঘা মারল। ওর মন যেন অস্ফুটে বলে উঠল, ‘চিনি, একে চিনি।
কিন্তু কোথায়, কবে, কখন, কেমন করে?
এই প্রশ্ন মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে বিনীতা শুভ্রেন্দুর দেহের অন্যান্য ক্ষতস্থানও জলন্যাকড়া বুলিয়ে পরিষ্কার করে ফেলল। তারপর ওদের শােবার ঘরে গিয়ে একটা মাদুর আর বালিশ এনে তাতে অতিকষ্টে ঠেলে গড়িয়ে তুলে দিল জ্ঞানলুপ্ত শুভ্রেন্দুর দেহটা। এরপর ছুট্টে গিয়ে এক বাটি পরিষ্কার জল এনে ওর চোখে মুখে থেকে থেকে ঝাপ্টা মারতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
কি করবে তা যেন ভেবে পায় না। বিনীতা বরদলৈ। একটা মানুষ তাদের ঘরে তিল তিল করে শুকিয়ে মরবে অথচ তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না? হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায় সেবার যখন ওর দাদা ফুটবল খেলতে গিয়ে পায় চোট খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল তখন একটা শিশিতে করে কি একটা ওষুধ এনেছিল—নাম বলেছিল ব্রাণ্ডি। সেটা খেলে নাকি গায়ের ব্যধা মরে। তার কিছুটা এখনও আছে। ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল বিনীতা। একটু পরেই ফিরে এসে শুভ্রেন্দুর মুখে ফোঁটার পর ফোঁটা ফেলে দিতে লাগল শিশিটা কাত করে।
মাঝে মাঝেই ও সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ে লক্ষ্য করতে থাকে শুভ্রেন্দুর জ্ঞান ফেরে কিনা। থেকে থেকে নাকের কাছে হাতের পিঠ নিয়ে পরীক্ষা করে শ্বাস প্রশ্বাস বইছে কিনা।
অনেকক্ষণ পর শুভ্রেন্দুর ঠোঁটদুটো যেন একটু কেঁপে উঠল বলে মনে হল বিনীতার। ও আরও আগ্রহে ঝুঁকে পড়ল। শুনল সে বন্দী মানুষটা বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।
বিনীতা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ঝুঁকে পড়ে শুভ্রেন্দুর মুখের কাছে কান পাতে। শুভ্রেন্দু তখন বিড়বিড় করে বলছে:
—কি ছেলে মানুষী করছ শিবানী, আমাদের পরিত্রাণ নেই।
শিবানী। শিবানী। শিবানী! তড়িতাহতের মত বিনীতা সােজা হয়ে বসে। বিদ্যুতের মত ঝিলিক মেরে ওঠে নামটা। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনের পর্দায় সর্বঅবয়ব নিয়ে ভেসে ওঠে শিবানীর মূর্তিটা। মুখে সুন্দর একটা লজ্জা—যে লজ্জা কারও মুখে প্রেমের গােপন কথাটি ফাঁস হয়ে গেলেই দেখা যায়। তাকে ঘিরে ধরা মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরছে একটা ফটো। হ্যাঁ, সেই ফটোতেই ওরা দেখেছিল সহপাঠিনী শিবানীর ফিঁয়াসে—এই ভদ্রলােককে।
সেই ভদ্রলােকের এই অবস্থা। তা হলে ওরা দুটিতেই এই কাটাকাটির রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই সুযােগে ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে এই কুটিল আন্দোলন রূপ ব্যাধ বিচ্ছেদের তীর হেনেছে। ভাবতে ভাবতে বিনীতার কর্তব্যবােধ চাগিয়ে ওঠে। হাতের ব্র্যাণ্ডির শিশিটা থেকে আরও কয়েকফোঁটা ঢেলে দেয় শুভ্রেন্দুর মুখে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় রান্নাঘরে। উনান থেকে সবে জ্বাল দিয়ে নামানো গরম দুধ একটা বাটিতে কয়েক হাত তুলে নিয়ে আবার ত্রস্তে ফিরে আসে। ফিরে এসে আবার বসে ও শুভ্রেন্দুর শিয়রে। একটু পরই সে তাকায় তার ঘােরলাগা চোখে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে চেয়ে জায়গাটা বুঝতে চেষ্টা করে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। অস্ফুট স্বরে শিয়রে বসে থাকা বিনীতাকে শুধায় :
—শিবানী, শিবানী কোথায়?
—শিবানী কোথায় আমি ত জানি নে। তবে আমি ওর বন্ধু। আমি ওর সঙ্গে হাণ্ডিকুই গার্লস কলেজেই পড়ি। ঘটনাচক্রে আপনি এসে পড়েছেন আমার জিম্বায়।
—ও, তা আপনি যখন শিবানীর বন্ধু, দয়া করে একটা উপকার করতে পারবেন আমার?
টেনে টেনে অতি কষ্টে কথা বলে শুভ্রেন্দু।
—বলুন।
সাগ্রহে শুভ্রেন্দুর মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ে বিনীতা শুধায়।
—আমাকে এখুনি বিষ খাইয়ে বা বুকে ছুরি বসিয়ে মেরে ফেলতে পারেন?
শােনামাত্র ঋজু হয়ে মাথা তুলে বসে বিনীতা। বলে :
—দেখুন, আপনার কথাটা বিদ্রুপের শােনালেও ওটা কঠিন বাস্তব। মারবার লােকের এদেশে এখন অভাব নেই। কিন্তু আমি তাদের দলের নই। বাঁচার সাধ যদি থাকে, বলুন, আমি যে করেই হােক সব ঝুঁকি নিয়েও সাহায্য করব।
—বাঁচার সাধ আমার ঘুচে গেছে । দেহের কোষে কোষে আমার কী যে যন্ত্রণা। তাই ত’ মরতে চাই আমি মরতে চাই।
—আমি অতটা উপকার আপনার করতে পারব না, সে জন্য দুঃখীত। তবে এখন এই দুধটুকু দয়া করে খেয়ে নিন ত
–ওতে কিছু হবে না। দয়া করে আপনি আমায় মেরে ফেলুন। শিবানীর প্রকৃত বন্ধুর কাজ করুন।
—মৃত্যুত’ আপনার মাথার কাছে কিন্তু তার চেয়ে এক কুটিল ষড়যন্ত্র চলছে আপনাকে নিয়ে। ওরা আপনার বাবার কাছে টেলিগ্রাম করছে মুক্তিপণ হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে এলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে জানিয়ে। কিন্তু ওটাও ওদের ছল। আপনার বাবা যদি টেলিগ্রামের ছলনায় ছলিত হয়ে চলে আসেন তবে আপনাদের পিতা-পুত্রকে এক সঙ্গেই…
—উঃ ভগবান!
কপালে করাঘাত করতে শুভ্রেন্দু হাত তুলতে গিয়ে আবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে “উঃ বলে।
—দেখুন, ভেঙ্গে পড়লে ত’ চলবে না। তা ছাড়া আমিও খুব নিশ্চিন্ত মনে যে এখানে আছি, তা নয়। দাদা দলবল নিয়ে চলে আসার আগেই আমায় এঘর থেকে চলে যেতে হবে।
—আচ্ছা, একটা অন্ততঃ কাজ করতে পারেন? বলুন?
—বাবাকে আমার নাম করে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে পারেনতাতে শুধু লেখা থাকবে–Do not come-Subhrendu
—দেখুন, যদিও আমি আপনার শত্ৰুপুরীর মেয়ে তবু বলছি চেষ্টা করে দেখবাে, কথা দিতে পারছি নে। কেননা জানেন ত’ ডাকবিভাগের অনেক কর্মী নাকি বেঙ্গলিদের টেলিগ্রাম আটকে দিচ্ছে। তা ছাড়া অনেক দূরে মহকুমা শহরে তার অফিস। বিশ্বাসী লােক দিয়ে পাঠাতে হবে ত’
—বেশ, তাই দেখবেন।
যন্ত্রণাকাতর ক্ষীণ কণ্ঠে বলে শুভ্রেন্দু।
—কিন্তু তার আগে আমার কথাটা রাখুন, এই দুধটুকু অন্ততঃ খেয়ে নিন।
—-বিশ্বাস করুন, আমার একটুও ইচ্ছে নেই এখন…
—জানি। তবু এটা আমার Satisfaction এর জন্য প্রয়ােজন। কেননা Now I am nursing you.
—বেশ, বলছেন আপনি…
বলতে বলতে উঠতে যায় শুভ্রেন্দু। কিন্তু পারে না! সারা গায়ে তার কী কষ্টকর যন্ত্রণারই না জ্বালা।
—না-না, আপনাকে এ অবস্থায় উঠতে হবে না
বলতে বলতে ওকে উঠতে বাধা দেয় বিনীতা।
—আমি চামচ নিয়ে এসেছি—তাই দিয়ে আপনার মুখে দিয়ে দিচ্ছি। হাঁ করুন!
বিনীতার এ অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না শুভ্রেন্দু। সেবাময়ী বিনীতার এক অদ্ভুত রূপ যেন শুভ্রেন্দুর চোখে ধরা পড়ে। মনে মনে ভেবে দেখে এমন করে বলা এমন কারাে অনুরােধ অবহেলা করা যায় না। দুধটুকু ওকে খাওয়াতে পেরে অদ্ভুত এক তৃপ্তি পায় বিনীতা। বলে :
—আমার আর বেশীক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। তবে আপনাকে অনুরােধ, যখনই ঘর খােলার শব্দ পাবেন তখনই যেন বেহুসের মত পড়ে থাকবেন। এতে দাদা ও তার দলবল হয়তাে আর কোন নৃশংস অত্যাচার করবে না আপনার দেহের ওপর। বলুন, আমার কথা রেখে এটুকু কপট আচরণ করবেন আপনি
ক্ষীণ একটু হাসে শুভ্রেন্দু -থৈ থৈ মেঘে ঢাকা এক চিলতে চাদের স্নিগ্ধ কিরণের মত। বলে:
—আপনি শিবানীর বন্ধু; তাই আমার বন্ধু, আপনার কথা রাখা শােভন হবে না।
একথা শুনে বিনীতার মন খুশীতে ভরে যায়। মনে মনে ভাবে যদি কোনদিন শিবানীর সঙ্গে আর দেখা হয় তবে তাকে বলবে:
—এমন ভদ্র cultured লোক যে তুই বেছে নিতে পেরেছিস, এটা তাের পক্ষেই সম্ভব।
এই কথা ভাবতে ভাবতেই মনে ও মুখে একটা খুশীর রেশ নিয়ে বিনীতা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বেরিয়ে দরজা টেনে যথারীতি তালা আটকে দেয়। তারপর দুধের বাটি ও ব্রাণ্ডির শিশি যথাস্থানে রেখে ঢেকে গিয়ে ঠাকুমার ঘরে। ঠিক এমন সময়ই বরদাকান্ত বাড়ি ফেরে। সে দোরের কাছে এসে শিকে ডেকে বন্দীর ঘরের চাবিটা চেয়ে নেয়। তারপর এগিয়ে যায় বাঙ্গাল বন্দীটার অবস্থা দেখতে।
দাদার এ আচরণে ভয়ে বিনীতার সারা গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। এতক্ষণও মনের একটা সুন্দর ইচ্ছার ইঙ্গিতে সবকিছু করে এসেছে—পরিণামের কথা ভাবেনি। তাই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ঠাকুরমার কাছে হাঁটু ভেঙ্গে বসে তার কোলে মুখ গুজে ভীতস্বরে বলে।
-–ঠাকুমা, কি হবে।
—তাের ভয় কি বিনী, আমি ত আছি।
বৃদ্ধার কথা শেষ হতে না হতেই বরদাকান্ত হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে আসে:
—বিনী? বিনী?
—দাদা!
অপরাধী কণ্ঠে কোনক্রমে সাড়া দেয় বিনীতা। ইতিমধ্যে সশব্দে বন্দীর ঘরের দোরে আগল দিয়ে তালা মেরে বরদাকান্ত এসে গেছে উঠানের আধখানা পেরিয়ে।
—ওকে জামাই আদরে মাদুরে উঠিয়ে বালিশে শুতে দিয়েছিস কেন?
—শুইয়েছে, বেশ করেছে।
দৃঢ়স্বরে বলেন বৃদ্ধা
—গেরস্তর ঘরে —যতক্ষণ আছে, অতিথি নারায়ণ। আমি বলেছি বিনীকে ওর সেবা করতে। তােরা যখন এ বাড়ির সীমানা থেকে ওকে নিয়ে যাবি তখন যা খুশী করিস, কিচ্ছুটি বলতে যাব না।
—আচ্ছা, যত পার সেবাযত্ন কর, কতক্ষণ আর, কাল বিকেলের মধ্যেই ওর উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে।
—বিনী ?
এ কথা বলে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে আবার ডাকে:
—দাদা!
—আমি স্নানে চললাম, ঠাই করে ভাত বেড়ে দে অনেক কাজ আছে আমার।
নিজের ঘরে চলে যায় বরদাকান্ত। আর বিনীতার মনে উৎকণ্ঠা—আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ওর জাগে বান্ধবী শিবানীর জীবনের একমাত্র অবলম্বন বন্দী ভদ্রলােকের ভবিষ্যৎ ভেবে।
রাত্রি নামে পৃথিবীতে। কৃষ্ণপক্ষের ঘন কালো আঁধারে অস্তিত্ব হারায় পৃথিবীর সব আলাে। রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ প্রকৃতি বিদীর্ণ হয়ে আসপাশের বাঙ্গালীদের বাড়ীঘরগুলো পেট্রোলের আগুনে জ্বলে ওঠে। লকলকে লেলিহান অগ্নিশিখা তার ব্যাদান মুখে যেন বাঙ্গালীদের ভবিষ্যৎ গ্রাস করে। থেকে থেকে নিগৃহীত নির্যাতিত মানবাত্মার ভয়ার্ত ক্রন্দনে আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে।
বিনীতা বারবার ব্যস্ত হয়ে গৃহাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরের উঠোনে। আবার পরক্ষণেই ফিরে যায় ভেতর বাড়ীতে। তার সারা অন্তর জুড়ে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা ও চাঞ্চল্য। একটা দম আটকানো উদ্বেগ, সীমাহীন উৎকণ্ঠা। নিষ্ঠুরতার উৎপীড়ণে অতিষ্ঠ মানুষের অনেক অনেক করুণ কান্না ও ভয়ার্ত চীৎকার বাতাসে ভেসে এসে ওকে আকুল করে তােলে।
ওদের ঘরেও ত নিৰ্যাতীত এক নিস্পাপ মানুষ অশেষ ক্লেশে বন্দীত্ব বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। হয়তাে তাকেও এই হনন যজ্ঞের বলি হতে হবে। অসহায় মানুষকে জোর করে মৃত্যুর করালগ্রাসে ঠেলে দেবার কী ভীষণ সম্মিলিত বীভৎস ষড়যন্ত্র । এই অন্যায় অত্যাচার থেকে ক্লিশিত মানুষের মুক্তির কোন ব্যবস্থা যদি তার জানা থাকত। যদি একটি মুহূর্তের জন্য ভগবানের মন ও সর্বশক্তিমনিতা লাভ করত সে। তবে সেই সবগুলি শক্তি প্রয়ােগে মানুষের মনকে মুক্ত করত পশুতার পঙ্কিলতা থেকে। বিভেদ ও বীভৎস স্বভাবের কালেকুটিল ঈর্ষার পরিবর্তে সবার মনে সঞ্চারিত করত সুন্দর অমলিন ভ্রাতৃপ্রেম।
হঠাৎ যেন হৃদয়ের কোন অন্ধকার কোপ থেকে সুন্দর একটা চিন্তার সৌগন্ধে অনুবাসিত হয় বিনীতার, নরম নারীমন। হয় মনের সেই সৌগন্ধ বুঝি এখনই সে নাসারন্ধ্র পথে ঘ্রাণরূপে টেনে নিতে পারবে প্রশ্বাসের সঙ্গে। সেই সুন্দর গন্ধ যেন ওর মনকে সব কিছু ভয়, শঙ্কা, দ্বিধার হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে এক অভিলসিত স্বর্ণ-পথের সন্ধান দেয়। যে পথে শুধুমাত্র সৎ ও মহৎ জনরাই মাত্র বিচরণ করার অধিকার অর্জন করে। সেই স্বর্ণপথের পথিক হবার অটুট সঙ্কল্প নিয়ে বিনীতা এগিয়ে যায় বাইরের আঙ্গিনা থেকে ভেতরে। তারপর সে আঙ্গিনাও অতিক্রম করে ও গিয়ে দাঁড়ায় একটা বদ্ধ ঘরের কাছে। কি এক অনির্বচণীয় অনুভূতির অনুরণ চলেছে তখন ওর দেহের রােমে রােমে।
খুট করে দরজা খােলার শব্দ শােনামাত্র শুভ্রেন্দু বসা থেকে শুয়ে পড়ে। ঠিক যেমন পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিল বিনীতা-অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ও। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে মরার মত বেহুস হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাদুরে। একটু পর ওর কানে আসে নারীকণ্ঠের অস্ফুট স্বর:
—শুনছেন!
ভুল নয়। চিনতে পাবে শুভ্রেন্দু এ স্বর। চোখ খুলবে খুলবে ভাবতে ভাবতেই আবার সেই কোমলতার উজ্জ্বল অস্ফুট স্বর কানে আসে:
—কই, উঠুন, উঠে পড়ুন!
এবার চোখ মেলে চায় শুভ্রেন্দু। দেখে এক কল্যাণী মূর্তি তার বরাভয় দৃষ্টিতে মহৎ এক আশ্বাসের আভাষ দিয়ে যেন তার দিকে চেয়ে আছে। বিনীতা আবার বলে:
—এইবার পালান!
—কি বলছেন আপনি।
বিস্ময়ের বারিধিতে যেন হাবুডুবু খায় শুভ্রেন্দু।
—ঠিকই বলছি। ওরা সব এখন নিশাচরদের মত বাঙ্গালীমেধ যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিতে বেরিয়ে গেছে। এই সুযােগে আপনি পালান। উত্তেজনায় শুভ্রেন্দুর হৃৎপিণ্ডদুটো দাপাদাপি করে যেন। বলে:
—কিন্তু ওরা যদি আপনাকে এজন্য নিৰ্যাতন করে।
—সে নিৰ্যাতন সইবার শক্তি ভগবান আমায় দেবেন। আপনাকে ভাবতে হবে না। কিন্তু সে নিৰ্যাতন যদি আমার ওপর সেজন্য আসে তা সইতে পারব এই ভেবে যে বন্দী পাখিকে ওরা এখন আর ওদের নাগালে পাবে না। তাই সে নির্যাতন সওয়া আমার সার্থক হয়েছে বলে মনে করব আমি।
একটা অদ্ভুত জ্যোতির্ময় আশা যেন আলাে ছড়ায় শুভ্রেন্দুর মনের মধ্যেটায়। সে আবার বাঁচবে! আবার মা, বাবা, শিবানীর সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি। এ কি সত্যিই সম্ভব হতে চলেছে? না কি এ কোন ছলনাময়ী নারীর ছল মাত্র? অথবা স্বর্গের পথ ভুল করে কোন দেবী মানবী রূপ ধরে তার মত এক আর্ত মানুষের মহা উপকার করতেই মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন।
—Please, দেরী করবেন না। প্রতিটি মুহূর্ত এখন যে আপনার কাছে মরকত মণির চেয়েও মূল্যবান ! উঠুন, উঠে পড়ুন।
এত আন্তরিক অনুনয়ে বলতে বলতে তার মনে হয় সে যেন তার মনের অনুবাসিত চিন্তা থেকে স্বর্গোদ্যানের প্রস্ফুটিত পারিজাতের গন্ধ পাচ্ছে আজ। কি মিষ্টি, কি স্নিগ্ধ, কি সুন্দর সে স্বর্গীয় সৌরভ।
অবশেষে দুরুদুরু বুকে বিছানায় উঠে বসে শুভ্রেন্দু। হ্যাঁ সে যেন একটু একটু করে তার দেহের কোষে কোষে হৃতবল ফিরে পাচ্ছে। উঠে দাঁড়ায় ও অবশেষে চোখে মুখের এক উজ্জ্বল আভা নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে বিনীতাও। বিহবল, হৃদিত শুভ্রেন্দু অভিভূতের মত বিনীতার একটা হাত দু’হাতের মুঠোয় টেনে নেয় উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে ওঠে সে হাত। অন্তর নিভৃতের সবচেয়ে সৌরভযুক্ত কৃতজ্ঞতা জানাতে যায় শুভ্রেন্দু—কিন্তু কোন কথা ওর মুখ হতে বের হয় না। ঠোঁটদুটো শুধু আবেগে কাঁপে, ও বলতে চায়।
—“মনুষ্যত্ব আবার তােমাদের মনের পুষ্পক রথে চেপেই ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার মানুষগুলাের মনে মনে সঞ্জীবিত হােক বােন! কিন্তু কিছুই বলা হয় না। পরক্ষণেই হঠাৎ বিনীতার হাতটা ছেড়ে দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে নিকষকালাে আঁধারে মিশে যায় শুভ্রেন্দু।
বিনীতার চোখের কোল বেয়ে ঝরতে থাকে তখন ফোঁটার পর ফোঁটা অশ্রু জল। তবে দুঃখে নয়—নিষ্ঠুরতার ঝড়ের ঝাপ্টা থেকে মনুষ্যত্বের প্রদীপের অন্ততঃ একটা শিখাও সে জ্বেলে রাখতে, পেরেছে—তারই আনন্দে।
নোট : বানান অবিকৃত